আ. লীগে থাকা 'যুদ্ধাপরাধীদের' তালিকা দিল বিএনপি

>
  • ২২ জনের তালিকা
  • বিএনপির প্রকাশ করা এই তালিকার ছয়জন সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী এবং সাংসদ
  • এবারও তাঁরা প্রার্থী

জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও যুদ্ধাপরাধীদের নিকটাত্মীয়দের ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়ন দিয়ে সমালোচনার মুখে থাকা বিএনপি এবার আওয়ামী লীগে ‘যুদ্ধাপরাধী’ থাকার অভিযোগ এনেছে।

বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের ২২ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে দাবি করছে, এসব ব্যক্তি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন বা পাকিস্তান সরকারের হয়ে কাজ করেছেন। এঁদের মধ্যে ৯ জন এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করছেন।

গত রোববার বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এই ২২ জনের নামের তালিকা গণমাধ্যমকে দেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে, এমন অভিযোগে এক ডজন ব্যক্তির বিচার করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু আওয়ামী লীগে থাকা রাজাকারদের ব্যাপারে একেবারে নীরব।

বিএনপির অভিযোগ, আওয়ামী লীগেও অনেক কুখ্যাত রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য ও স্বাধীনতাযুদ্ধে মানবতাবিরোধী ব্যক্তি আছেন। এমন ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা এখন আওয়ামী লীগের বড় নেতা বা তাদের টিকিটে এবার নির্বাচন করছেন।

সংবাদ সম্মেলনে যাঁদের নামে অভিযোগ করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সাংসদ মো. ফারুক খান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান সাংসদ মহীউদ্দীন খান আলমগীর, আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ সাংসদ এইচ এন আশিকুর রহমান ও সাংসদ মোসলেম উদ্দিন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী।

এর মধ্যে কামরুল ইসলাম সম্পর্কে বিএনপির অভিযোগ, তিনি রাজাকার পরিবারের সদস্য। তাঁর বড় ভাই হাকিম হাফেজ আজিজুল ইসলাম ১৯৭১ সালে নেজামে ইসলামী পার্টির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ঢাকায় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। একই সঙ্গে তিনি রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীকে সহযোগিতা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আজিজুল ইসলামের মালিকানাধীন প্রিন্টিং প্রেসে কামরুল ইসলাম ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৬৯ সালে এ দেশে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন জোরদার হলে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার প্রচারণা চালাতে নেজামে ইসলাম নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করে নেজামে ইসলামী পার্টি। হাকিম আজিজুল ইসলাম এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। কামরুল বড় ভাইকে সার্বিক সহযোগিতা করতেন। মুক্তিযুদ্ধে ইসলামী দল বইয়ে এই বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ আছে বলে বিএনপি দাবি করেছে।

তবে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি, প্রশিক্ষণও নিয়েছি। আমার সঙ্গে হাসানুল হক ইনু ছিলেন, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ছিলেন। আমার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন মোস্তফা মোহসীন মন্টু। তাঁকে জিজ্ঞেস করেন। যাঁরা এসব বলছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

চারবারের সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খানের বিষয়ে বিএনপি দাবি করছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের পক্ষে দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে প্রথম অপারেশন চালান এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। সূত্র হিসেবে বিএনপি দিনাজপুরের মুক্তিযুদ্ধ নামক বইয়ের নাম উল্লেখ করে।

মো. ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা পুরোপুরি মিথ্যা কথা। এই প্রথম এমন কথা শুনলাম। আমি পাকিস্তানের একটি একাডেমিতে একজন শিক্ষানবিশ হিসেবে ছিলাম। পরে পাকিস্তান থেকে ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিয়ে আসি এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিই। আমার সম্পর্কে এসব তথ্য সেনাবাহিনীতে রক্ষিত রয়েছে। যাচাই করে দেখতে পারেন।’

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিষয়ে বিএনপির অভিযোগ, তিনি একাত্তরে শান্তি কমিটিতে ছিলেন। তাঁর পিতা নুরুল ইসলাম নুরু মিয়া ফরিদপুরের শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন। দৃশ্যপট একাত্তর: একুশ শতকের রাজনীতি ও আওয়ামী লীগ শীর্ষক বইকে (পৃষ্ঠা ৪৫) বিএনপি সূত্র হিসেবে উল্লেখ করেছে।

খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবার নাম জোর করে শান্তি কমিটিতে ঢোকানো হয়েছিল। সে সময় যারাই চেয়ারম্যান ছিল, তাদের সবার নামই জোর করে ঢোকানো হয়। আর আমি’ ৭১ সালে জাতিসংঘে কাজ করতাম। আমার বাবা ইন্তেকাল করেছেন, তাঁর নামে এসব মিথ্যা যাঁরা বলছেন, তাঁরা যদি এটি প্রমাণ না করতে পারেন, তবে তাঁদের বিরুদ্ধে আমি এক শ কোটি টাকার মানহানির মামলা করব।’

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর সম্পর্কে বিএনপির বক্তব্য হচ্ছে, তিনি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ময়মনসিংহে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি পাকিস্তান সরকারের অধীনে চাকরি করে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সহযোগিতা করেছেন। মেজর (অব.) এস এস এম আরেফিন রচিত মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান বইয়ে (পৃষ্ঠা–৩৫০) মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তাদের তালিকায় তাঁর নাম আছে।

একই বইকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে বিএনপি বলছে, এইচ এন আশিকুর রহমানও ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের অধীনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে টাঙ্গাইলে কর্মরত ছিলেন। দলটির দাবি, আশিকুর রহমান পাকিস্তান সরকারকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেন।

ময়মনসিংহ-৬ আসনের সাংসদ মোসলেম উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন বলে দাবি করছে বিএনপি। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসানের দেওয়া যুদ্ধাপরাধের তালিকায় (যুদ্ধাপরাধের তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গ) ক্রমিক নং-৭৩–এ তাঁর নাম রয়েছে। মোসলেম উদ্দিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গত ৬ এপ্রিল (প্রকৃতপক্ষে মামলাটি হয়েছে ২৩ জানুয়ারি) ময়মনসিংহের আদালতে মামলা করেছেন জালাল উদ্দিন নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ফুলবাড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক।

বিএনপির দাবি, আওয়ামী লীগ প্রথম যুদ্ধাপরাধীকে মন্ত্রী বানিয়েছেন। তিনি মাওলানা নুরুল ইসলাম। ১৯৯৬ সালে জামালপুর–৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর তাঁকে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী করে আওয়ামী লীগ সরকার। আসাদ বিন হাফিজের লেখা দৃশ্যপট একাত্তর: একুশ শতকের রাজনীতি ও আওয়ামী লীগ শীর্ষক গ্রন্থের (পৃষ্ঠা–৪৫) বরাত দিয়ে বিএনপি বলছে, নুরুল ইসলাম ১৯৭১ সালে জামালপুরের সরিষাবাড়ী এলাকার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে রাজাকাররা ওই এলাকায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। নুরুল ইসলাম গত মাসে মারা গেছেন।

বিএনপি যেসব সূত্রের কথা উল্লেখ করেছে, তা যাচাইয়ের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান ও দৃশ্যপট একাত্তর: একুশ শতকের রাজনীতি ও আওয়ামী লীগ শীর্ষক বই দুটিতে পৃষ্ঠা নম্বরসহ উল্লেখিত তথ্যের মিল পাওয়া গেছে।

ডা. এম এ হাসানের লেখা যুদ্ধাপরাধের তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গ বইটির যে তথ্যসূত্র দেওয়া হয়েছে, সেটারও মিল পাওয়া গেছে। অন্য যেসব সূত্র বা দলিলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো কিছুটা দুষ্প্রাপ্য।

এ ছাড়া বিএনপির এই তালিকায় শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বেয়াই মুসা বিন শমসের (যুদ্ধাপরাধের তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গ, ক্রমিক–৫৯৫), আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ, প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের বাবা মির্জা কাশেম ও জামালপুরের বকশীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কালাম আজাদের বাবা আবদুল কাইয়ুম মুন্সীর নামও উল্লেখ আছে। এর মধ্যে আবদুল কাইয়ুম মুন্সীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুটপাট ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার অভিযোগে গত ৬ এপ্রিল জামালপুর আদালতে মামলা করেছেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। বিএনপির তালিকায় গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগের ১০ জন নেতার নাম রয়েছে। দাবি করা হয়েছে, তাঁরা যুদ্ধাপরাধী, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখেছিলেন। সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে কোটালীপাড়ায় ইউনিট মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার মজিবুল হকের সই করা ২০০৮ সালের ১ আগস্ট প্রকাশিত ‘গোপালগঞ্জের যুদ্ধাপরাধীর তালিকা’। এ ব্যাপারে জানতে মজিবুল হকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর মুঠোফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।

তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মজিবর রহমান হাওলাদার, কোটালীপাড়া উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী রাফেজা বেগমের বাবা আবদুল বারেক হাওলাদার ও ভাই আজিজুল হক, গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতা আবুল কালাম দাড়িয়ার বাবা মালেক দাড়িয়া, কোটালীপাড়া উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি আমির হোসেনের বাবা মোহন মিয়া, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়ার বাবা মুন্সি রজ্জব আলী দাড়িয়া, কোটালীপাড়ার পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগের নেতা এইচ এম অহেদুল ইসলামের বাবা বাহাদুর হাজরা, ভগ্নিপতি রেজাউল হাওলাদার প্রমুখ। এর বাইরে তালিকায় আরও দুজনের নাম উল্লেখ ছিল, কিন্তু তাঁদের ব্যাপারে কোটালীপাড়ার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের সদস্যের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

বিএনপির এই তালিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও দলের অন্যতম মুখপাত্র হাছান মাহমুদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এঁরা যদি যুদ্ধাপরাধী হয়, তাহলে দেশে কয়েক কোটি যুদ্ধাপরাধী আছে। মাত্র ২২ জনের নামের তালিকা প্রকাশ না করে আরও বেশি তালিকা তাদের দেওয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, ‘মূলত বিএনপি নিজেরাই যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষক, লালনপালনকারী। এ বিষয়টি আড়াল করার জন্য এবং এ বিষয়ে থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য একটা সস্তা স্টান্টবাজি করছে।’