দেশেই শনাক্ত হবে জিনগত রোগ

>

• বিসিএসআইআরের জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণাগার উদ্বোধন
• গবেষণাগারে ১২ কোটি টাকা মূল্যের আধুনিক যন্ত্র বসানো হয়েছে
• নির্ভুলভাবে বংশগতির বিভিন্ন রোগের দায়ী জিন শনাক্ত করা যাবে

বাংলাদেশে শুরু হয়েছে সম্পূর্ণ মানবশরীরের জিন–নকশা (জিনোম সিকোয়েন্সিং) বের করার কার্যক্রম। এতে দেশেই জিনগত রোগ শনাক্ত করার সুযোগ পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে দেশীয় পণ্যের স্বীকৃতি এবং স্বত্ব আদায় করতে আর বিদেশি গবেষণাগারের কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হবে না।

গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জিনোমিকস গবেষণাগারে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকাল এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। তিনি বলেন, ‘জিনোম সিকোয়েন্স এবং স্পেসিফিক মিউটেশন বের করার জন্য বর্তমানে দেশ থেকে বহু নমুনা বিদেশে চলে যায়, যেটি খুব ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশকের স্বীকৃতি পেতে এখন আর আমাদের বিদেশি গবেষণাগারের প্রয়োজন হবে না। এর ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনা সম্ভব।’

বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাঁদের গবেষণাগারে সিঙ্গাপুর থেকে আনা প্রায় ১২ কোটি টাকা মূল্যের আধুনিক যন্ত্র বসানো হয়েছে। এটি দিয়ে তিন দিনে ৪৮ জন মানুষের নমুনা থেকে ক্যানসার ও বংশগত রোগ নির্ণয়ের জন্য মানুষের সম্পূর্ণ জীবনরহস্য বা জিন–নকশা বের করা যাবে। এর মাধ্যমে অন্যান্য দেশের বংশগত রোগের মার্কারগুলোর সঙ্গে দেশের রোগের মার্কারগুলো মিলিয়ে একটি রেফারেন্স মাইক্রো চিপ তৈরি করা হবে। এতে খুব সহজে নির্ভুলভাবে এবং অল্প খরচে বংশগতির বিভিন্ন রোগের দায়ী জিন শনাক্ত করা যাবে।

মানুষের সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে খুব সহজে নির্ভুলভাবে অজানা রোগ নির্ণয় করা যায়। দেশের বাইরে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের পরীক্ষা করাতে হয় বলে রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি মূল্যবান জিনগত তথ্যও পাচারের ঝুঁকি থাকে।

জীববিজ্ঞানের ভাষায়, জীবনরহস্য বা জিন–নকশা (জিনোম সিকোয়েন্স) হচ্ছে জীবের সমস্ত বংশগতির তথ্যের সমষ্টি। মানবদেহে প্রায় ৩৭ ট্রিলিয়ন কোষ থাকে। প্রতিটি কোষই জীবের বিকাশ ও গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা বহন করে। কোনো জীবের জিনোম বলতে সেটির সমস্ত বংশগতির তথ্যের সমষ্টিকে বোঝায়, যা ডিএনএ ও আরএনএতে সংকেতাবদ্ধ থাকে। ডিএনএর প্রধান কাজ দীর্ঘকালের জন্য তথ্য সংরক্ষণ করা। পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং হচ্ছে কোনো জীবের জিনোমে সব নিউক্লিওটাইডসমূহ (জৈব অণু) কীভাবে বিন্যস্ত রয়েছে তা বের করা। একটি জীবের মোট জিনের সংখ্যা, বৈশিষ্ট্য এবং তাদের কাজের বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স থেকে জানা যায়। 

যেসব সুবিধা মিলবে

জিনোম সিকোয়েন্সিং করার জন্য চারজন বিজ্ঞানীর দল বিসিএসআইআরের জিনোম গবেষণাগারে কাজ করছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এই প্রকল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা। প্রাথমিকভাবে ২০ জন স্তন ক্যানসার রোগীর জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে বলে জানান জিনোমিক গবেষণাগারের প্রকল্প পরিচালক ও বিসিএসআইআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সেলিম খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে খুব সহজে নির্ভুলভাবে অজানা রোগ নির্ণয় করা যাবে। সবচেয়ে আধুনিক যন্ত্র দিয়ে ২০ জন ক্যানসার রোগীর সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স বের করার কার্যক্রম চলছে। এতে করে একটি জিনের তথ্যভান্ডার (ডেটাবেইস) তৈরি করা হবে। সে তথ্যভান্ডারে থাকা তথ্য দিয়ে কোনো মানুষের সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স মিলিয়ে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হবে। শুরুতে জিনের বিন্যাস বের করতে খরচ প্রায় এক লাখ টাকা পড়লেও পরে তা কমে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা হবে।

সারা বিশ্বে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেটর) হিসেবে পণ্যের স্বীকৃতি ও স্বত্ব অর্জনের একটি প্রবণতা চলছে। বাংলাদেশও এর থেকে পিছিয়ে নেই। পাট ও ইলিশের জীবনরহস্য বের করে বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই স্বীকৃতি ঘরে এনেছেন। তবে এসবের কোনোটির জীবনরহস্য দেশের কোনো পরীক্ষাগারে বের করা হয়নি। জিনোম গবেষণাগারের শুরু হওয়া এই কার্যক্রম থেকে দেশের মাটিতে গবেষণা করে এখন থেকে পণ্যের স্বত্ব আদায় সম্ভব হবে বলে জানান বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানীরা।