আদমপুরের ঘরে ঘরে 'টাকার' বাক্স

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আদমপুরে বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষের ব্যাপকতা বেড়েছে। ছবি: প্রথম আলো
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আদমপুরে বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষের ব্যাপকতা বেড়েছে। ছবি: প্রথম আলো

গ্রামে ঢুকতেই বিভিন্ন বাড়িতে চোখে পড়বে কাঠের বাক্স। টিনের চাল, বারান্দা, কার্নিশসহ এখানে-সেখানে ফেলে রাখা হয়েছে। গুনগুন শব্দ তুলে বাক্সের ছিদ্র দিয়ে আসা-যাওয়া করছে মৌমাছি। ফুলে ফুলে ঘুরে সংগ্রহ করা মধু তারা রাখছে বাক্সে। বিন্দু বিন্দু করে জমা হওয়া মধু মিলে যখন ভরে উঠছে বাক্স, সেগুলো বিক্রি করে বাড়তি টাকা পকেটে তুলছেন বাড়িওয়ালা।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুরের লোকজন তাই এই বাক্সগুলোর নাম দিয়েছেন ‘টাকার’ বাক্স। আগে থেকেই টুকটাক মধুর চাষ ছিল এই অঞ্চলে। তবে বছর দশেক ধরে বাণিজ্যিকভাবে চাষের ব্যাপকতা বেড়েছে। একেক বাড়িতে ২টি থেকে ৩০টি পর্যন্ত বাক্স রাখা হয়েছে। তেমন কোনো পরিশ্রম ছাড়াই একেক বাক্স থেকে বছরে গড়ে ১০ হাজার টাকা আয় হয় বলে জানালেন কমলগঞ্জ উপজেলা মধুচাষি উদ্যোক্তা উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি আলতাফ মাহমুদ তালুকদার।

আদমপুরের মধ্যভাগ গ্রামের এই মধুচাষি স্কুলশিক্ষক গত ২১ নভেম্বর নিজের বাড়িতে নিয়ে দেখান, তাঁর ঘরের পাশে, শিমঝাড়ের নিচে, পুকুরের পাড়ে, সবজিখেতের পাশে বাক্স বসানো। এই বাক্সগুলো মৌমাছির ‘কলোনি’। যাতে মৌমাছি মধুর চাক তৈরি এবং মধু উৎপাদন করে। মৌমাছি সারা দিন বন-বাদাড় ঘুরে মধু সংগ্রহ করে কলোনিতে এনে জমা রাখে। কলোনি পূর্ণ হয়ে উঠলে মধু বের করা হয়। যা বিক্রি করে হাতে নগদ টাকা পান বাক্সের মালিক। উপজেলার আদমপুর ও ইসলামপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে এখন এই মধুচাষির সংখ্যা চার শতাধিক বলে জানান আলতাফ মাহমুদ। 

বাক্সগুলো মৌমাছির ‘কলোনি’। ছবি: প্রথম আলো
বাক্সগুলো মৌমাছির ‘কলোনি’। ছবি: প্রথম আলো


যেভাবে শুরু
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, আদমপুর এলাকার পাশেই পড়েছে রাজকান্দি বন। বিস্তৃত এই বনের গাছে গাছে মধুর চাক তৈরি করে মৌমাছি। পেশাদার মধুশিকারিরা সেখান থেকে মধু সংগ্রহ করে হাট-বাজারে বিক্রি করেন। খাঁটি এই মধুর খোঁজে আদমপুরে ছুটে আসেন ক্রেতারা। তবে প্রাকৃতিক মধু দিয়ে সবার চাহিদা মেটানো যায় না। তাই এলাকায় দু-চারটা কাঠের বাক্স বানিয়ে মৌমাছির কলোনি সৃষ্টি করে মধুর চাষ শুরু হয়। লাভজনক হওয়ায় বছর ১০-১২ ধরে এই মধু চাষ বাণিজ্যিকভাবে এলাকার ঘরে ঘরে সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রায় বাড়িতেই আছে এক-দুটি বাক্স।

মধুচাষিরা জানান, রাজকান্দি পাহাড়ের কাছে কাঁঠালকান্দি গ্রামের আজাদ মিয়া একজন মধুশিকারি। তিনি গাছের ঝুলন্ত চাক থেকে মধু সংগ্রহ করেন। তিনি পাহাড় থেকে ‘রানি মৌমাছি’ ধরে আনেন। কাঠের বাক্সে কলোনি তৈরি করেন। এরপর সেই রানি মৌমাছিসহ কলোনি বিক্রি করেন। আজাদ মিয়া জানান, এতে করে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে মধু চাষ। এখন আরও অনেকেই এই কাজে যুক্ত হয়েছেন। 

গ্রামের একেক বাড়িতে ২–৩০টি পর্যন্ত বাক্স রাখা হয়েছে। ছবি: প্রথম আলো
গ্রামের একেক বাড়িতে ২–৩০টি পর্যন্ত বাক্স রাখা হয়েছে। ছবি: প্রথম আলো


কলোনি থেকে মধু
মধুচাষিরা জানান, কলোনিতে থাকা একটি রানি মৌমাছিকে ঘিরে শ্রমিক মৌমাছিরা চাক বোনা শুরু করে। এরপর শুরু হয় মধু সংগ্রহ। রানি মৌমাছি না থাকলে মৌমাছিরা সেখানে থাকে না। আবার একটি চাক বা কলোনিতে একটিই রানি মৌমাছি থাকে। একাধিক রানি মৌমাছি হলে ঝগড়াঝাঁটি শুরু হয়। যা বুঝতে পারেন চাষিরা। তখন রানিদের আলাদা করে না দিলে একজন দলবল নিয়ে আশপাশের গাছের ডালে গিয়ে আশ্রয় নেয়। দিনে দিনে কলোনিটি মৌমাছিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। মধুতে ভরে ওঠে কলোনি। একটা কলোনিতে পাঁচ থেকে সাত হাজার মৌমাছি থাকে। এই মৌমাছির একটি নাম আছে, দাসকুলি। এই দাসকুলি জাতের মৌমাছিরই শুধু চাষ করা যায়। এ ছাড়া রাজমধু, মাছি মধু, ঘামি মধু ও মধুমালতী জাতের মৌমাছিরা প্রাকৃতিকভাবে বনে-জঙ্গলে মৌচাকে মধু জমায়।

একটি বাক্স থেকে বছরে কম করে হলেও তিনবার মধু সংগ্রহ করা যায়। বছরে যার পরিমাণ প্রায় ১০ কেজি। প্রতি কেজি মধু এক হাজার টাকা করে বিক্রি করে আয় হয় আট-দশ হাজার টাকা। যাঁদের আট-দশটা কলোনি আছে, তারা বছরে বাড়তি কোনো পরিশ্রম ছাড়াই লাখ টাকা আয় করেন।

একটি কাঠের তৈরি বাক্স বা কলোনি বানাতে খরচ পড়ে আড়াই হাজার টাকা। যাঁদের কাছ থেকে এই বাক্স কেনা হবে, তাঁরাই রানি মৌমাছিসহ কলোনিটি সাজিয়ে দেবেন। শুধু জায়গামতো বাক্সটি রেখে দিয়ে মাঝেমধ্যে পরিচর্যা এবং মধুতে ভরে উঠলে সংগ্রহ করতে হয়। 

একেক বাক্স থেকে বছরে গড়ে ১০ হাজার টাকা আয় হয়। ছবি: প্রথম আলো
একেক বাক্স থেকে বছরে গড়ে ১০ হাজার টাকা আয় হয়। ছবি: প্রথম আলো


কোটি টাকার ব্যবসা
আদমপুর ইউনিয়নের মধ্যভাগ, উত্তরভাগ, বনগাঁও, কোনাগাঁও, নোয়াগাঁও, আধকানি, জালালপুর, নইনারপাড় এবং ইসলামপুর ইউনিয়নের কাঁঠালকান্দি, ছয়ঘরি, নোয়াগাঁও, রাজকান্দি, কানাইদেশি ও কলোনি এলাকায় প্রায় ৪০০ মধুচাষি আছেন। এর মধ্যে আদমপুরে ৩০০ এবং ইসলামপুরে ১০০ চাষি। মধুচাষিরা জানালেন, সারা বছরে এই এলাকায় এখন প্রায় কোটি টাকার মধু উৎপাদন ও বিক্রি হচ্ছে।

মধ্যভাগের গ্রাম্য চিকিৎসক মনির আলীর এখন মধু চাষেও সমান আগ্রহ ও দক্ষতা। মনির আলী জানান, তাঁর এখন ৩৩টি বাক্স আছে। এর মধ্যে ২২টা বাড়িতে। ১১টা বিভিন্ন স্থানে রেখেছেন। মনির আলী বলেন, ‘গেল ভাদ্র মাসে ৪২ হাজার টাকার মধু বিক্রি করেছি। বছরে লক্ষাধিক টাকার মধু বিক্রি করি। বাক্স বানানো ছাড়া আর কোনো খরচ নেই। পোকা (মৌমাছি) ঘরে এনে টাকা দিয়ে যায়। নিজে রানি মৌমাছি ধরতে পারি। মধু সংগ্রহ করতে পারি। কারও সহযোগিতা লাগে না।’

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) থেকে এলাকার ১০ জন মধুচাষিকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ দেওয়া হয়েছে। আরও প্রশিক্ষণ ও সরকারি আর্থিক সহযোগিতা দরকার। আদমপুর ও ইসলামপুর এই অঞ্চলে মধু চাষের জন্য একটি প্রাকৃতিক অনুকূল পরিবেশ আছে বলে চাষিরা মনে করেন। মধুচাষি ফুরকান মিয়া জানান, বনের ভেতর অনেক রকম স্থানীয় মৌসুমি ফল-ফুলের গাছ আছে। এসব থেকে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে।

কমলগঞ্জ ক্ষুদ্র কুটির শিল্পোদ্যোক্তা উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ও উপজেলা মধুচাষি উদ্যোক্তা উন্নয়ন পরিষদের উপদেষ্টা আহমদ সিরাজ বলেন, ‘এই এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে মধু চাষ হতো। এখন অনেক ব্যাপকতা পেয়েছে। চার শতাধিক মধুচাষি। এটি এলাকায় ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন উৎপাদিত মধু প্রক্রিয়াজাত করার একটি উদ্যোগ নেওয়া দরকার।’

বিসিক শিল্প নগরী মৌলভীবাজারের উপব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা আদমপুর এলাকার মধুচাষিদের কিছু প্রশিক্ষণ ও ঋণ দিয়েছি। ভবিষ্যতেও এই কার্যক্রম চলবে।’