শফিউল দাঁড়াতে পারবেন তো?

ট্রেন দুর্ঘটনায় দুই পা হারানোর পরপর অনেকে শফিউলকে দেখতে এসেছিলেন। সহানুভূতি জানিয়েছিলেন। কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্থা করে তাঁকে অন্তত চলাচলের উপযোগী করে দেবেন বলে অনেকে আশ্বাসও দিয়েছেন। তবে এখনো কেউ কথা রাখেননি। জীবনযুদ্ধে ফেরার জন্য দুটি কৃত্রিম পা তাঁর খুবই প্রয়োজন।

গত সোমবার শফিউল আলম খানের সঙ্গে কথা হয়। পরিবারে ও পাড়ায় শান্ত নামেই তিনি পরিচিত। শফিউলের বাসা সিরাজগঞ্জ পৌরসভার মীরপুর বিড়লাকুঠি মহল্লায়। তাঁর বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা প্রায় একটা বেজে যায়। পাড়ার গলির মাথায় শফিউলের বাসার ঠিকানা জিজ্ঞেস করতেই তিন-চারজন এগিয়ে এসে বাড়ির অবস্থান জানালেন। সদর দরজায় কড়া নাড়তেই হুইলচেয়ারে বসা একজন এসে দরজা খুলে সালাম দেন। বোঝার বাকি থাকে না—এ তরুণই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র শফিউল আলম খান। প্রায় এক বছর আগে ট্রেন দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন তাঁর দুই পা।

বেদনার সেই স্মৃতি খুঁড়ে আনেন শফিউলসহ তাঁর পরিবারের সদস্যরা। শফিউলের বাবা শাহাজাহান আলী খান অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। শফিউল সিরাজগঞ্জ বিএল সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও রাজধানীর রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত গণিত বিভাগে।

শফিউল জানান, গত বছরের ২২ জানুয়ারি সরস্বতী পূজার ছুটি শেষে ঢাকা যাচ্ছিলেন তিনি। সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান নিচে। তাঁর দুটি পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায় ট্রেনের বেশ কয়েকটি বগি। প্রাণে বাঁচলেও হারাতে হয় দুই পা।

স্থানীয় লোকজন শফিউলকে উদ্ধার করে প্রথমে সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যার বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাঁকে ঢাকায় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) স্থানান্তর করা হয়।

সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে শফিউল আরও জানান, বঙ্গবন্ধু সেতুতে সেদিন সকালে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটায় প্রচণ্ড যানজট ছিল। শেষে ঢাকা থেকে ভাড়ায় হেলিকপ্টার এসে তাঁকে নিয়ে যায়। সেই থেকে শুরু ব্যয়বহুল চিকিৎসার। পঙ্গু হাসপাতালে টানা এক মাস ১৭ দিন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরেন তিনি। অনেকে তাঁর চিকিৎসার খরচ ও উন্নত মানের দুটি কৃত্রিম পা সংযোজনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। তবে শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। বাবার অবসরকালীন টাকা, জমি বিক্রিসহ পরিবারের জমানো প্রায় ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে তাঁর চিকিৎসার জন্য। প্রায় নিঃস্ব পরিবারটির সামনে এখন শুধুই অন্ধকার।

শফিউলের মা শাহিদা খাতুন বলেন, বড় ছেলেটা তাঁর চাচার ব্যবসা দেখাশোনা করেন। শফিউল মেধাবী হওয়ায় তাঁকে নিয়ে পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত মেধাবৃত্তি পেয়েছেন শফিউল। পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। ঘরভর্তি শফিউলের পুরস্কার আর কৃতিত্বের সনদ। অথচ দুর্ঘটনায় দুই পা হারানোয় এখন ঘরের ভেতরই দিন কাটে তাঁর।

মায়ের আশা, ছেলের জন্য কেউ না কেউ কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্থা করবেন। দুটি পা সংযোজন করা গেলে শফিউল আগের মতো না হলেও নিজে নিজে চলাফেরাটুকু করতে পারবেন। ছেলেকে আবারও দুই পায়ে দাঁড়াতে সহায়তা করার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের দানশীল মানুষের সহযোগিতা কামনা করেন।

ট্রেন দুর্ঘটনায় দুই পা হারানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শফিউল। ছবি: প্রথম আলো
ট্রেন দুর্ঘটনায় দুই পা হারানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শফিউল। ছবি: প্রথম আলো

মা যখন কথা বলছিলেন, তখন চোখ ভিজে উঠছিল শফিউলের। আবার পড়ালেখায় যুক্ত হতে সহায়তা পাওয়ার আকুতি ছিল তাঁর কণ্ঠেও। জীবন থেকে একটি বছর ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে। সময়ের হিসাবে এটা খুব বেশি সময় নয়। আবারও সবকিছু শুরু করা সম্ভব। উন্নত চিকিৎসায় আবারও সম্ভব দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর। হুইলচেয়ার ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও পা ফেলতে চান শফিউল। পরিবারের জন্য বোঝা হতে চান না। কেউ কি দাঁড়াবেন পা হারানো মেধাবী শফিউলের এই ছোট্ট একটি ইচ্ছে পূরণে?