উপজেলা নির্বাচন নিয়ে চ্যালেঞ্জ

>
  • কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাইলে বাধা দেওয়া হবে না
  • মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি আলাদা ভোট করবে
  • ১৪ দলের নিবন্ধিত দলগুলোকে আলাদাভাবে ভোট করতে বলা হয়েছে

দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠেয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একক প্রার্থী দেবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিএনপিসহ বিভিন্ন দল বর্জনের ঘোষণা দেওয়ায় মার্চে অনুষ্ঠেয় উপজেলা নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করাটা ক্ষমতাসীন দলের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্র জানায়, এই পরিস্থিতিতে দলের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাইলে বাধা দেওয়া হবে না। অর্থাৎ দলের নেতাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেকটা উন্মুক্তই রাখা হবে। পাশাপাশি বিএনপির নেতাদের মধ্যে কেউ আগ্রহী থাকলে তাঁরা যাতে স্বতন্ত্র হিসেবে ভোট করতে পারেন, সে জন্য তাঁদের উৎসাহী করা হবে।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের নিবন্ধিত দলগুলোকে আলাদাভাবে ভোট করতে বলা হয়েছে। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি আলাদা ভোট করবে। নির্বাচনে বেশি প্রার্থীর অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানোর এলাকা, দলীয় প্রার্থী ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অবস্থান বিবেচনা করে কৌশল ঠিক করা হবে।

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, জাতীয় নির্বাচনের পর পর উপজেলা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। বিরোধী দল না থাকলে আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হলে সেটা আবার সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠে কি না, তা নিয়ে চিন্তা আছে দলের। কারণ, এই নির্বাচনে বদনাম নিতে চায় না আওয়ামী লীগ। এ জন্য উপজেলা পরিষদ নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে কঠোর অবস্থানে থাকে, সেটাও নিশ্চিত করা হবে। এ ছাড়া উপজেলা নির্বাচন যাতে একতরফা না হয়ে যায়, সে কৌশল নিয়ে ভাবছে আওয়ামী লীগ।

অবশ্য আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেছেন, উপজেলা নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। এতে আওয়ামী লীগ একক প্রার্থীই দেবে।

বিএনপি গত বৃহস্পতিবার স্থায়ী কমিটির বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বর্তমান সরকার আর নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না দলটি। এরপর গতকাল খুলনায় এক অনুষ্ঠানে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, শতভাগ প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও তাঁরা সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা ও কাজে মিল না থাকায় তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান। আটটি বাম দলের সমন্বয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোটও নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে। শিগগির তারা আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত জানাবে বলে জানা গেছে।

এই বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মনে করেন, শেষ মুহূর্তে বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবে। আর দলীয়ভাবে অংশ না নিলেও বিএনপির অনেক নেতা, কর্মী ও সমর্থক স্বতন্ত্রভাবে অংশ নিতে পারেন।

সারা দেশে ৪৯২টি উপজেলা আছে। এর মধ্যে ৪৮১টি উপজেলায় পাঁচ ধাপে নির্বাচন হবে। আগামী মার্চে চার ধাপে ৪৬৪টি নির্বাচন শেষ করার পরিকল্পনা আছে নির্বাচন কমিশনের। বাকিগুলোতে ভোট হবে ঈদুল ফিতরের পর।

১৪ দলে আছে সংশয়
১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন বাদে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনই ১৪ দলের শরিকেরা আলাদা আলাদা অংশ নিয়েছে। এবারও তারা আলাদাভাবেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু), জাসদ (আম্বিয়া), গণতন্ত্রী পার্টিসহ অনেক দলই ফেব্রুয়ারির প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে বৈঠক ডেকেছে। তবে নির্বাচনটা কেমন হবে, এই নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন শরিক দলগুলোর অনেক নেতা। তাঁরা বলছেন, ২০১৫ সালের পৌরসভা নির্বাচন ও ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা প্রায় সব স্থানেই জবরদস্তি করেছেন। ওই সব নির্বাচনে অনেক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সহিংসতায় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর অনুপস্থিতিতে এবার আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাত হয় কি না, এই বিষয়ে কিছুটা শঙ্কা আছে শরিকদের।

এ ছাড়া জোটগতভাবে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরও এবার ১৪ দলের শরিক দলের কেউ মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। নির্বাচনের পর ১৪ দলের আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠকও হয়নি। আওয়ামী লীগের বিজয় উদ্যাপন অনুষ্ঠানেও ১৪ দলের আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ ছিল না। ৩০ জানুয়ারি সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে। সেই সংসদে ১৪ দলের শরিকদের অবস্থান কী হবে, এই নিয়ে সংশয়ে আছে তারা। এই পরিস্থিতিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আলোচনা শুরু হয়েছে।

যদিও ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য আনিসুর রহমান মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা নির্বাচন জোটগতভাবে হবে না। তাঁরা আলাদাভাবেই নির্বাচন করবেন। জাসদের একাংশের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া বলেন, তাঁদের দলের নিবন্ধন নেই, তাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে অংশ নেবেন। জাসদের অপর অংশের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, তাঁরা নিজেদের মতো করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একই কথা জানিয়েছেন গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন।

দলীয় প্রতীকে ভোট নিয়ে ভিন্ন চিন্তা
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির বর্জন, ইউনিয়ন ও পৌরসভায় সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে এবার উপজেলা পরিষদের নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার বিষয়ে মত আছে আওয়ামী লীগের ভেতরেই। জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোট শরিক ১৪ দলের অনেক নেতা মনে করছেন, উপজেলা নির্বাচন অরাজনৈতিক হলেই ভালো। এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ত। চাইলে আগামী সংসদে উপজেলা পরিষদ আইনের সংশোধন করা যেতে পারে। তবে দলীয় প্রতীকে ভোট করার বিধানসহ ২০১৫ সালে উপজেলা পরিষদ আইন হওয়ার পর নির্বাচন হয়নি। ফলে নির্বাচন না করেই আইনটি সংশোধনের বিষয়ে সরকারপ্রধান রাজি হবেন কি না, এটা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না এই ধারণার পক্ষের নেতারা।