সড়ক, যান, চালক কিছুই ঠিক নেই

কেরানীগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শিশু আফসার আহমেদ ও আফিফা আক্তার। ছবি: সংগৃহীত
কেরানীগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শিশু আফসার আহমেদ ও আফিফা আক্তার। ছবি: সংগৃহীত

পরিবহন খাতে এ মুহূর্তে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণহানি কমানো। সড়ক, যানবাহন এবং দক্ষ চালক—পরিবহন খাতে শৃঙ্খলার তিন মূল নিয়ামক। কিন্তু দেশের এর কোনোটিই ত্রুটিমুক্ত নয়। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

আবার আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে এ খাতকে সুশৃঙ্খল রাখার ব্যবস্থাও কার্যকর নয়। সেখানে বড় বাধা রাজনৈতিক প্রভাব। ফলে বিশৃঙ্খলার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে পরিবহন খাত। জনপ্রত্যাশা মেনে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে প্রাণহানি কমানো ছাড়া সরকারের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।

গত মাসে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। ২০১৬ সালের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) তথ্যই বলছে, দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের ৬২ শতাংশে যথাযথ সাইন-সংকেতের ব্যবস্থা নেই। জাতীয় মহাসড়কের অন্তত ১৫৪ কিলোমিটার মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। আর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব বলছে, দেশে ৩৮ লাখ যানবাহন চলছে। এর মধ্যে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৫ লাখের কাছাকাছি। একই সূত্রমতে, দেশে বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহনের জন্য চালক আছেন প্রায় ২০ লাখ। অর্থাৎ ১৮ লাখ যানবাহন ‘ভুয়া’ চালক দিয়ে চলছে। অর্থাৎ ৪৭ শতাংশের বেশি গাড়ি চলছে ‘ভুয়া’ চালক দিয়ে। গত বছরের আগস্টে সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামার পর শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকার নানা প্রতিশ্রুতি দেয়। বিভিন্ন দপ্তর তাৎক্ষণিক কিছু তোড়জোড় শুরু করে থেমে যায়। ঘটা করে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করলেও খোদ ঢাকা শহরেই পরিবহনের বেহাল পরিস্থিতির ন্যূনতম কোনো উন্নতি চোখে পড়েনি।



গত বছরের ২৫ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিজেই সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি আলোচনায় আনেন। ঈদযাত্রায় প্রাণহানির প্রসঙ্গ টেনে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে পাঁচটি নির্দেশনা দেন। এগুলো হলো এক. দূরপাল্লার পথে বিকল্প চালক রাখা। যাতে একজন চালককে টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি চালাতে না হয়। দুই. নির্দিষ্ট দূরত্বে সার্ভিস সেন্টার বা চালকদের জন্য বিশ্রামাগার করা। তিন. গাড়ির চালক ও তাঁর সহকারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া। চার. সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করা বা অবৈধভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা। পাঁচ. চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা।

এই নির্দেশনার পর সওজ দুটি প্রকল্প নিয়েছে। একটি প্রকল্প হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-রংপুর ও ঢাকা-খুলনা—এই চার মহাসড়কের চারটি স্থানে বিশ্রামাগার নির্মাণ। এগুলো কুমিল্লার নিমসার, হবিগঞ্জের জগদীশপুর, সিরাজগঞ্জের পাঁচিলা ও মাগুরার লক্ষ্মীকান্দর নামক স্থানে স্থাপন করা হবে। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩৩ কোটি টাকা। প্রকল্পটি এখন পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায়। এ ছাড়া ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে যথাযথ সাইন-সংকেত বসাতে ৬৩২ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প নিয়েছে সওজ। এটিও পরিকল্পনা কমিশনে আছে।

জেব্রা ক্রসিং ধরে পারাপার, অবৈধ পারাপার বন্ধ পুরোপুরিই আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল। সিটবেল্ট বাঁধার বিষয়টিও আইনের প্রয়োগসংক্রান্ত। নিরাপদ সড়কের আন্দোলন শুরুর পর সরকার সড়ক পরিবহন আইন তড়িঘড়ি করে পাস করেছে। এরপর চার মাস পেরিয়ে গেলেও বিধি হয়নি। তাই আইনও কার্যকর হয়নি। এই সময়ক্ষেপণের পেছনে পরিবহন খাতে রাজনৈতিক প্রভাবকে কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আইনের বিরুদ্ধে গত নভেম্বর মাসে টানা ৪৮ ঘণ্টা ধর্মঘট পালন করে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। সারা দেশে পরিবহন খাতের শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি শ্রমিক সংগঠনের নেতা হলেও তাঁর পরিবারের মালিকানায় ঢাকায় ও দূরপাল্লার পথে বাস আছে। আরও অনেক সাংসদ ও সরকারদলীয় নেতা বাস ব্যবসায় যুক্ত। পরিবহনমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও সাংসদ মসিউর রহমান। মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। রাজনৈতিক মালিক-শ্রমিক নেতাদের কারণে সড়কে আইনের প্রয়োগ করা কঠিন বলে সড়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান।

বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে পুরোনো আইনে গত অর্থবছরে প্রায় ২৫ হাজার মামলা এবং ৫ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করেছে। একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি চালককে যানবাহন চালাতে না দেওয়ার বিষয়টি মোটরযান আইনেই আছে। কিন্তু চালকের সংকট এবং পরিবহনমালিক-চালকদের অনীহার কারণে সেটা বাস্তবায়িত হয় না। 

ইলিয়াস কাঞ্চন
ইলিয়াস কাঞ্চন


জানতে চাইলে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)–এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন না হওয়া তো ভয় পাওয়ার মতো ঘটনা। পুলিশ যে ট্রাফিক পক্ষ পালন করছে, এটি তো নতুন আইনে হওয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, সড়ক নিরাপদ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, সেগুলো আগে বাস্তবায়ন করা হোক। আর সড়কে সাইন-সংকেত নেই, এর জন্য টাকা খরচ করা হবে। কিন্তু দেশে তো চালকই নেই। যাঁরা আছেন তাঁরা তো সাইন-সংকেত বোঝেনই না। তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক।

বিআরটিএ বলছে, তারা গত এক বছরে ৮৪ হাজার পেশাজীবী যানচালককে দুই দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সচেতনতা বাড়াতে ৯৮টি সেমিনার এবং ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ৯৫টি সমাবেশ করেছে। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন ও কয়েক লাখ পোস্টার-লিফলেট বিলি করেছে।

সড়ক ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ
সওজের অধীন মোট সড়ক আছে ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক ৮ হাজার ৮৬০ কিলোমিটার। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব জরিপ বলছে, জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের মধ্যে ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার সড়কে যথাযথ সাইন-সংকেত নেই। কোথাও কোথাও থাকলেও তা ত্রুটিপূর্ণ। অর্থাৎ ৬২ শতাংশ জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে যথাযথ সাইন-সংকেত নেই। সওজ সূত্র জানায়, বিভিন্ন মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলমান থাকায় সেগুলোতে সাইন-সংকেত বসানোর বিষয়টি ধরা আছে।

এরপরও যে ৬২ শতাংশ সড়কে সঠিক সাইন-সংকেত নেই এবং দুর্ঘটনার মারাত্মক ঝুঁকি আছে, সেসব সড়ক উন্নয়নে ৬৩২ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে প্রয়োজনীয় সাইন ও রোড মার্কিং স্থাপন এবং চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ স্থানসহ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ করিডর উন্নয়ন’।

সড়ক খাতে এ পর্যন্ত যত ব্যয় হয়েছে, এর বেশির ভাগই হয়েছে সেতু নির্মাণ ও সড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজে। বাকিটা মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ব্যয় হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত সওজের অধীনে সড়ক ও সেতু নির্মাণ এবং মেরামতে সাড়ে ৫৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। আরও প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান আছে।


২০১২ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে জরিপ চালানো হয়। সে জরিপে ৩০০ কিলোমিটার সড়ক মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার সড়কে ঝুঁকি কমাতে বাঁক সোজাকরণ, সড়ক প্রশস্ত করাসহ নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে ১৫৪ কিলোমিটার সড়ক এখনো মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। এই ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এসব স্থানে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানায় হাইওয়ে পুলিশ ও বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। এর জন্য সওজ এআরআইকে করণীয় ঠিক করে দেওয়ার জন্য দায়িত্ব দিয়েছে।

সড়কে অহরহ দেখা যায় এরকম লক্করঝক্কর গাড়ি। প্রথম আলো ফাইল ছবি
সড়কে অহরহ দেখা যায় এরকম লক্করঝক্কর গাড়ি। প্রথম আলো ফাইল ছবি


ফিটনেসবিহীন যানের ছড়াছড়ি
বিআরটিএ সূত্র বলছে, গত ১ আগস্ট সারা দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৩৩। ওই মাসেই নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা মাঠে নামে। বিআরটিএ কার্যালয়গুলোতে ফিটনেস সনদ নেওয়ার হিড়িক পড়ে। তারপরও গত ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩০।

বিআরটিএর একাধিক কর্মকর্তা জানান, ফিটনেস দরকার হয়—এমন যানবাহনের প্রায় ৪০ শতাংশেরই এখন বৈধতা নেই। মোটরযান আইনে ফিটনেস দেওয়ার আগে ৬০ ধরনের কারিগরি ও বাহ্যিক দিক বিবেচনা করতে হয়। কিন্তু একজন মোটরযান পরিদর্শক দিনে শখানেক যানের ফিটনেস সনদ দিয়ে থাকেন। ফলে যেসব যানবাহন সনদ পাচ্ছে, সেগুলোও যে চলার উপযুক্ত, তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। ছালবাকল ওঠা যেসব বাস রাস্তায় চলে, পরীক্ষা করলে এর বেশির ভাগেরই হালনাগাদ সনদ পাওয়া যাবে।

বিআরটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতি সম্প্রতি এক স্মারকলিপিতে চোখে দেখে ফিটনেস সনদ দেওয়ার পরিবর্তে যন্ত্রের মাধ্যমে এই কাজ করার সুপারিশ করেছে। শুধু মিরপুর কার্যালয়ে একটি যন্ত্রের মাধ্যমে কিছু যানবাহন পরীক্ষা করে সনদ দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ১০ শতাংশের ১ শতাংশ যানেরও সঠিক ফিটনেস যাচাই করার সক্ষমতা নেই বিআরটিএর। এই কাজ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।

চালকের লাইসেন্স ব্যবস্থাপনাও খারাপ
বিআরটিএ সূত্র বলছে, বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহনের জন্য চালক লাইসেন্স আছে প্রায় ২৮ লাখ। এর মধ্যে একই লাইসেন্সে একজন ব্যক্তি মোটরসাইকেল ও অন্য যানবাহন চালান। এদের বাদ দিলে চালকের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২০ লাখ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৮ লাখ। অর্থাৎ ১৮ লাখ যানবাহন ‘ভুয়া’ চালক দিয়ে চলছে।

চালকের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন, প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ স্কুলের অনুমোদন, সচেতনতা বৃদ্ধি—সবই করার দায়িত্ব বিআরটিএর। সংস্থাটির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের জনবল মাত্র ৬৮৯ জন। ফলে লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা যথাযথভাবে নেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক জেলা কার্যালয়ে পরীক্ষা নেওয়ার জায়গাও নেই। ফলে মানুষ দালাল ধরে কোনোরকমে লাইসেন্স পাচ্ছে।

খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, চালকের ব্যাপক সংকট চলছে। এই অবস্থায় বিকল্প চালক রাখা অসম্ভব। তবে সরকার জায়গা দিলে তাঁরা নিজের অর্থে চালক প্রশিক্ষণ একাডেমি করতে চান।

আইনের প্রয়োগ হয় না
মামলা হলে দুর্ঘটনার বিষয়ে পুলিশ প্রতিবেদন দেয়। তাতে ৬০ টির মতো তথ্য উল্লেখ করতে হয়। এর মধ্যে দুর্ঘটনায় দায়ী কে, তা–ও চিহ্নিত করা হয়। ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত হওয়া দুর্ঘটনা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা ইনস্টিটিউট (এআরআই) বলছে, ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার পেছনে অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাব দায়ী। সাম্প্রতিক সময়ে মহাসড়কে ছোট যানবাহনের চলাচলও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে। এ জন্য ২০১৫ সালে মহাসড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। একই বছর জাতীয় মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, হিউম্যান হলার, নছিমন, করিমন ও ভটভটি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিন্তু এসব কার্যকর হয়নি।

গত বছর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়কে এআরআই দুটি প্রকল্পের পরামর্শ দেয়। একটিতে প্রতি দুই কিলোমিটার অন্তর স্পিড রাডারগান বসানো এবং ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন রাখার কথা বলা হয়। এই ব্যবস্থায় কোনো গাড়ি গতিসীমা অমান্য করল কি না, দুর্ঘটনায় পড়লে দ্রুত উদ্ধারসহ নানা ব্যবস্থা থাকবে। অন্যটি হচ্ছে চালকদের প্রশিক্ষক তৈরি এবং চালকদের প্রশিক্ষণ প্রদান। দুটি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা। প্রথম প্রকল্পটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আছে। দ্বিতীয়টির কোনো অগ্রগতি নেই।

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক নিরাপদ করতে তিনটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। একটা সাইন–সংকেত উন্নয়ন, বিশ্রামাগার নির্মাণ ও সড়কে অতিরিক্ত মালবাহী যান নিয়ন্ত্রণে ২৩টি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন। পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু হবে। এর বাইরে সড়ক চার লেন ও ছয় লেনে উন্নীত করার প্রকল্পগুলোতে এখন ধীরগতির যানের জন্য আলাদা লেন করা হচ্ছে। তাতে দুর্ঘটনা কমবে।

চালকের ঘাটতি আছে স্বীকার করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব বলেন, সরকার এক লাখ চালক তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। এর মধ্যে ৩৬ হাজার চালক তৈরি করবে সরকারের পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি। এর বাইরে পেশাদার চালকদের যথাযথ পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে লাইসেন্স প্রদানের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধে বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। জেলা প্রশাসকদেরও এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

সামছুল হক
সামছুল হক


বিশেষজ্ঞ মত
সরকারকে সত্যের কাছাকাছি যেতে হবে
সামছুল হক, পরিবহন ও সড়ক বিশেষজ্ঞ

প্রধানমন্ত্রী, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট এবং মন্ত্রী—সব জায়গা থেকেই নির্দেশনা এসেছে। এখন আর নির্দেশনায় কাজ হবে না। কেন সড়কে সাইন-সংকেত নেই? কেন বিআরটিএ চালকের চেয়ে বেশি যানবাহন নিবন্ধন দিয়েছে? রাস্তায় সার্বক্ষণিক আইনের প্রয়োগ নেই কেন? এর জবাব আদায় করতে হবে। সরকারকে সত্যের কাছাকাছি যেতে হবে। কেন হলো না—এটা জানার পর, সরকারের দিক থেকে জোগানের কোনো ঘাটতি থাকলে সেটাও পূরণ করতে হবে।

আমরা বানাই, ভুলে যাই, পুনরায় বানাই—এই নীতিতে চলছি। রক্ষণাবেক্ষণের কথা কারও মনে থাকে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন হয়েছে বেশি দিন হয়নি। আমার প্রাথমিক গবেষণা বলছে, ৪০ শতাংশ সাইন-সংকেত নাই হয়ে গেছে। আরও ৩০-৪০ শতাংশ সাইন থাকলেও তা গাছের আড়ালে চলে গেছে। এটা তো হওয়ার কথা নয়। এর জন্য স্বতন্ত্র বিভাগ লাগবে। প্রকল্পনির্ভর টাকা খরচ করলেই হবে না। রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যবেক্ষণ ২৪ ঘণ্টা থাকতে হবে। অথচ মহাসড়কে যত্রতত্র বাস-ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার পরও মহাসড়কে চলছে ছোট যানবাহন। এসবের জন্য দুর্ঘটনা ঘটছে, প্রাণহানি বাড়ছে।

আমাদের দেশে যানবাহন তুলনামূলকভাবে কম। দক্ষ চালক আরও কম। ব্যাকরণ মেনে সড়ক নির্মাণ করা হয়নি। কিন্তু আমরা যে অর্থনীতির দিকে এগোচ্ছি, যে অর্থনীতি প্রত্যাশা করছি, এর সঙ্গে বর্তমান পরিবহন খাত পাল্লা দিতে পারবে না। দিল্লি বা ব্যাংককের মতো শহরে যত যানবাহন ও চালক আছে, আমাদের সারা দেশেও তা নেই। অথচ আমাদের দিল্লি ও ব্যাংককের মতো হতে হবে। এর প্রস্তুতি কোথায়?

বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব, নীতি দিয়ে অর্থনীতি ঠিক রাখা। এ জন্য তারা প্রয়োজনে ঋণের সুদ বাড়ায়, কমায়। সড়ক ও যানবাহনের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও এমন নীতি থাকতে হবে এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। 

অধ্যাপক সামছুল হক: পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), সাবেক পরিচালক সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট

আরও পড়ুন: