বৃহস্পতিবারও ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছেন আবজাল দম্পতি!
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানমের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ (ফ্রিজ) করার জন্য আদালত আদেশ দিলেও তাদের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ হয়নি। ব্যাংকের এসব হিসাব থেকে টাকা উত্তোলনসহ অন্যান্য লেনদেন চলছে। একাধিক ব্যাংকের সূত্রে এ তথ্যের সত্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
গত ২২ জানুয়ারি দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আবজাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানমের স্থাবর–অস্থাবর সম্পদ ক্রোক, অর্থাৎ, হস্তান্তর বা লেনদেন বন্ধ এবং ব্যাংক হিসাবগুলোর লেনদেন অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার আদেশ দেন আদালত।
আদালতের আদেশের পরপরই বিজি প্রেস থেকে গেজেট হয়েছে বলে জানায় একাধিক সূত্র। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে আদালতের আদেশ পৌঁছে গেছে। আদালত সুনির্দিষ্টভাবে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি সান ও বাংলা দৈনিক অগ্রসরে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করার জন্য আদেশে বলেছিলেন। সে মোতাবেক বিজ্ঞাপন প্রকাশ হয়েছে। আদালতের আদেশের কপি অগ্রণী ব্যাংক, এবি ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাছে পাঠানো হয় বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। কিন্তু অন্য কয়েকটি ব্যাংকে থাকা আবজাল দম্পতির হিসাবগুলো সচল।
জানা গেছে, আদালতের আদেশের পর গত দুই সপ্তাহেই আবজাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানমের ব্যাংক হিসাবে নিয়মিত লেনদেন হচ্ছে। রুবিনা খানমের মালিকানাধীন রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, যার মাধ্যমে সরকারি ঠিকাদারি কাজের বিল আদায় হতো সেটিও সচল আছে এবং লেনদেন চলছে। আবজালের নিজের নামে ও তাঁর যেসব নিকটাত্মীয়কে দুদক জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় এনেছে তাঁদের হিসাবও সচল। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ওইসব হিসাব সচল থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
ওইসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, জব্দের কোনো আদেশ না পাওয়ায় এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন তাঁরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো আদেশ নেই।
তবে দুদক সূত্র বলছে, তাঁদের কাছে সুনির্দিষ্ট যেসব ব্যাংক হিসাবের তথ্য ছিল সেগুলোর তথ্য উল্লেখ করে ব্যবস্থা নিতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে টাকা তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দুদকের কাছে থাকা তথ্যের বাইরে কোনো ব্যাংক হিসাব থাকলে সেখান থেকে হয়তো টাকা তুলতে পারে। কিন্তু আদালতের নির্দেশের পর কোনো ব্যাংক ওই দম্পতির টাকা ছাড় করলে সে বিষয়ে দুদক ব্যবস্থা নেবে।
সূত্র আরও জানিয়েছে, গত ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মহাব্যবস্থাপক বরাবর দুদক থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে আবজাল, তাঁর স্ত্রী ও নিকটাত্মীয়দের সব ব্যাংক হিসাবের বিষয়ে আদালতে নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
আবজাল হোসেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার সাবেক স্টেনোগ্রাফার। এখন তিনি রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে ব্যবসা করেন।
দুদকের তথ্য অনুযায়ী, আবজাল বেতন পান সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকার মতো। অথচ চড়েন হ্যারিয়ার ব্র্যান্ডের গাড়িতে। ঢাকার উত্তরায় তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে পাঁচটি। আরেকটি বাড়ি আছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আছে অন্তত ২৪টি প্লট ও ফ্ল্যাট। দেশে-বিদেশে আছে বাড়ি-মার্কেটসহ অনেক সম্পদ। এসব সম্পদের বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকারও বেশি।
এই দম্পতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমে গত ১০ জানুয়ারি আবজালকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। রুবিনা খানমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৭ জানুয়ারি দুদকে হাজির থাকতে বলা হলেও তিনি সময় চেয়ে আবেদন করেন। এর আগে আবজাল ও রুবিনার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক।
এর বাইরে আবজালের দুই ভাই ও তিন শ্যালককে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। আবজালের দুই ভাই হলেন—ফরিদপুর টিবি হাসপাতালে ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট বেলায়েত হোসেন ও জাতীয় অ্যাজমা সেন্টারে হিসাব রক্ষক লিয়াকত হোসেন। আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানমের তিন ভাইকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এঁরা হলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক রকিবুল ইসলাম, উচ্চমান সহকারী বুলবুল ইসলাম এবং খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অফিস সহকারী শরিফুল ইসলাম।
আবজাল হোসেনের বাড়ি ফরিদপুরে। ১৯৯২ সালে তৃতীয় বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর আর পড়াশোনা করা হয়নি তাঁর। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের সুপারিশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৫টি মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে অফিস সহকারী পদে অস্থায়ীভাবে যোগ দেন তিনি। ২০০০ সালে প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হলে তিনি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে অফিস সহকারী হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে ক্যাশিয়ার পদে বদলি হন। এই ধারাবাহিকতায় তিনি বর্তমান পদে যোগ দেন। সম্প্রতি তাঁকে সাতক্ষীরায় বদলি করা হলেও দুই মাসের মধ্যেই ঢাকা ফিরে আসেন আবজাল।
আবজাল হোসেনের স্ত্রী রুবিনা খানম একই প্রকল্পে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে যোগ দেন ১৯৯৮ সালে। ২০০০ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে গিয়ে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে ব্যবসা শুরু করেন। মূলত স্বামী-স্ত্রী মিলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একচেটিয়া ব্যবসা করার জন্য তাঁরা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
অফিস সহকারী বা কেরানি হিসেবে চাকরি নিলেও আবজাল হোসেন অল্প সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, বিএনপি আমলে নিয়োগ পেলেও সব আমলেই সমানভাবে প্রভাবশালী ছিলেন তিনি। নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, কাজ না করে বিল তুলে নেওয়ার মতো কাজগুলো করেছেন আবজাল। এর মাধ্যমে বিপুল বিত্তবৈভব গড়ে তুলেছেন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের অভিযোগ।
আরও পড়ুন...