রোহিঙ্গাদের জন্য সুবিচারের দাবি

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের বক্তারা। ছবি: প্রথম আলো
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের বক্তারা। ছবি: প্রথম আলো

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য সুবিচার দাবি করেছেন। তাঁরা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিচারের দাবি তুলে আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ দেন।

‘বার্মায় নিরাপত্তা ও জবাবদিহি’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলন ৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়। প্রথম দিন মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক তথ্য-অনুসন্ধানী গ্রুপের সদস্য রাধিকা কুমারস্বামী বাংলাদেশের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু শিবিরে তাঁর অভিজ্ঞতার মর্মস্পর্শী বিবরণ দেন। তিনি বলেন, বর্তমান আন্তর্জাতিক আইনের সাহায্য নিয়েই এই গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের সম্মুখীন করা যায়। জাতিসংঘ প্রক্রিয়ার বাইরে জাতীয় আইনের ভিত্তিতেও এই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব। এই গণহত্যায় উসকানিদাতা হিসেবে তিনি ফেসবুককে অভিযুক্ত করেন এবং তাদেরও বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানান।

সকালের অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় আশ্রয়প্রাপ্ত বিভিন্ন রোহিঙ্গা ব্যক্তি তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর অত্যাচারে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গাদের সংকট সমাধানে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত না হওয়ায় তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁরা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

গণহত্যাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক গ্রেগরি স্টানটন বলেন, তিনি আশাবাদী যে আগামী বছরগুলোয় এই গণহত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তবে শুধু এই বিচারের মাধ্যমেই রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না; রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতির পাশাপাশি এই অমানবিক কার্যকলাপের শিকার হিসেবে তাদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

রোমভিত্তিক পিপলস ট্রাইব্যুনালের সাধারণ সম্পাদক জিয়ানি তগনানি বলেন, গণহত্যার মুখে সবচেয়ে বড় অপরাধ নীরব থাকা। তিনি দাবি করেন, মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি নিজেও এ গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত, তাঁকেও বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক একাত্তরের গণহত্যার স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, যে বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসের এক ভয়ংকর গণহত্যার শিকার, তারাই আজ রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সমর্থনে স্থানীয় নাগরিক সংস্থাগুলো যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তিনি সেসবের সচিত্র বিবরণ তুলে ধরেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য চিত্রাঙ্কন শিবির, বিদ্যালয় স্থাপন ও অনাথ রোহিঙ্গা শিশুদের দত্তক গ্রহণের ব্যবস্থা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সহযোগিতায় বিখ্যাত ফুটবলার মেসি ও রোনালদো রোহিঙ্গাদের সমর্থনে অর্থ সংগ্রহে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে তিনি জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সি আর আবরার রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানে বাংলাদেশ সরকারের নজিরবিহীন সহযোগিতার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, পশ্চিমা ও আরব দেশগুলো যেখানে নামমাত্র আর্থিক সাহায্য দিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ করেছে, সেখানে বাংলাদেশ ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর দীর্ঘমেয়াদি আশ্রয়দানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। তিনি মনে করেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রশ্নে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক, রোহিঙ্গাদের সেই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাঁর মত, বাংলাদেশে আশ্রয়প্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের ‘উদ্বাস্তু’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে তৃতীয় কোনো দেশে তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব।

সম্মেলনের সূচনাপর্বে বিখ্যাত মানবাধিকারকর্মী এঞ্জেলা ডেভিস ও মিয়ানমারের মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ র‍্যাপোর্টিয়ার ইয়াং লি ভিডিওর মাধ্যমে পাঠানো বার্তায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি নিজেদের সংহতি প্রকাশ করেন।

আজ শনিবার সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন রোহিঙ্গা প্রশ্নে জাতিসংঘ, ইসলামিক কনফারেন্স ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। এ ছাড়া সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী সমাপ্তি ভাষণ দেবেন।