জামায়াত দেশে ঘৃণার পাত্র হয়ে গিয়েছিল

জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগকারী আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক
জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগকারী আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক

জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগকারী আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ’৭১-এর জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। দলটি দেশে ঘৃণার পাত্র হয়ে গিয়েছিল। এটাই তাঁকে বেশি পীড়া দিয়েছে। তিনি বলেন, একটি দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কেউ সে দেশের নেতৃত্ব দিয়েছে, এ রকম কোনো ইতিহাস তিনি খুঁজে পাননি।

লন্ডনে প্রথম আলোর সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে আবদুর রাজ্জাক এ কথা বলেন। আবদুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত পড়ুন আগামীকাল সোমবারের প্রথম আলো পত্রিকায়।

এই জামায়াত নেতা গত শুক্রবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) দল থেকে পদত্যাগ করেন। দলের আমির মকবুল আহমাদের কাছে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠান।

পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, জামায়াত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি। একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতার আলোকে ও অন্যান্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিবেচনায় এনে দলটি নিজেদের সংস্কার করতে পারেনি। পদত্যাগপত্রের এক জায়গায় আবদুর রাজ্জাক লেখেন, ‘ডিসেম্বরের নির্বাচনের (একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন) পর জানুয়ারি মাসে জামায়াতের করণীয় সম্পর্কে আমার মতামত চাওয়া হয়। আমি যুদ্ধকালীন জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে দায়দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিই। অন্য কোনো বিকল্প না পেয়ে বলেছিলাম, জামায়াত বিলুপ্ত করে দিন।’

লন্ডনে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আবদুর রাজ্জাক বলেন, পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নাসিম হাসান শাহ তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমি শুনেছি তুমি জামায়াত করো। তোমাকে একটা কথা বলি। দল হিসেবে ৭১-র বিষয়টির যদি সুরাহা না করতে পারো, তাহলে জামায়াত বেশি দূর এগোতে পারবে না।’
জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে নিজের যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমি তো একজন মুসলিম ডেমোক্র্যাট এবং ইসলামি মূল্যবোধ, যেটা আমি তো মনে করি সবচেয়ে বড় মূল্যবোধ। যদিও আমি মনে করি ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর মধ্যেই ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হবে। সুতরাং, এই মূল্যবোধের প্রসার ঘটানোর জন্যই আমি মনে করেছিলাম যে জামায়াত উপযুক্ত ফোরাম।’ এখন জামায়াতের বিকল্প হিসেবে তিনি মনে করেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের অধীনে মুসলিম উদার গণতান্ত্রিক দলের প্রয়োজন এবং সম্ভাবনা আমি দেখছি।’

আবদুর রাজ্জাক যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের নেতাদের প্রধান আইনজীবী ছিলেন। যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়ার ৫ দিনের মাথায় তিনি দেশ ছাড়েন। রাজ্জাক যুক্তরাজ্যেরও নাগরিক। এখন তিনি সেখানেই বসবাস করছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং নতুন নামে দল গঠন করে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার প্রস্তাব সম্প্রতি নতুন করে আলোচনায় এসেছে জামায়াতে ইসলামীতে। দলটির নেতৃত্বের একটা অংশ এ ধরনের প্রস্তাবের পক্ষে। এই অংশ একাত্তরের ভূমিকার জন্য ভুল স্বীকার করে বর্তমান নামে দলকে সচল রাখতে অথবা নতুন নামে দল গঠন করতে চায়।

গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার জন্য সম্প্রতি দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জরুরি সভা হয়। দলের তরুণ নেতৃত্বের দাবির মুখে সভায় একাত্তরের ভুল রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং জামায়াত নামক দল বিলুপ্ত করে সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে দলকে নিয়োজিত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা মজলিশে শুরায় অনুমোদন পায়নি।

নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। তারা দলীয় প্রতীক হারিয়েছে। তাদের কাজ করতে হচ্ছে গোপন দলের মতো।

রাজ্জাক পদত্যাগপত্রে লিখেছেন, ‘অতীতে আমি অনেকবার পদত্যাগের কথা ভেবেছি। কিন্তু এই ভেবে নিজেকে বিরত রেখেছি, যদি আমি অভ্যন্তরীণ সংস্কার করতে পারি এবং ’৭১-এর ভূমিকার জন্য জামায়াত জাতির কাছে ক্ষমা চায়, তাহলে তা হবে একটি ঐতিহাসিক অর্জন। কিন্তু জানুয়ারি মাসে জামায়াতের সর্বশেষ পদক্ষেপ আমাকে হতাশ করেছে।’

পদত্যাগপত্রের শেষ দিকে রাজ্জাক জামায়াতের নেতাদের প্রশংসা করেন। তিনি লেখেন, ‘গত ১০ বছরে জামায়াত নেতৃবৃন্দ অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেছেন। তা এখনো অব্যাহত। এটি প্রশংসনীয় যে এই কঠিন ও বৈরী সময়েও ব্যাপক কষ্ট এবং অসীম ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাধ্যমে জামায়াত নেতৃবৃন্দ দলের ঐক্য বজায় রেখেছেন। দলের প্রতি তাদের নিষ্ঠা এ একাগ্রতা অনস্বীকার্য।’ রাজ্জাক উল্লেখ করেন, এখন থেকে তিনি নিজস্ব পেশায় আত্মনিয়োগ করতে চান।