৮৭ উপজেলার ৫০টিতে আ.লীগ বনাম আ.লীগ

প্রথম ধাপে ৮৭টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ১৭ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। ৫০টি উপজেলায় রয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। আর বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও ১৬ উপজেলায় দলটির তৃণমূলের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার প্রথম ধাপের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনে প্রার্থিতার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।

প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় অধিকাংশ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, ২০–দলীয় জোট, বাম গণতান্ত্রিক জোট ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নির্বাচন বর্জন করেছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের শরিক ও মহাজোটের মিত্র দলগুলো অংশ নিলেও অধিকাংশ উপজেলায় মিত্রদের প্রার্থী নেই।

প্রথম ধাপের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৮৭টি উপজেলার চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন ২৮৬ জন। অধিকাংশ উপজেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা রয়ে গেছেন। একই উপজেলায় একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীও আছেন। ফলে বেশির ভাগ উপজেলায় লড়াই হবে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ।

প্রথম ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেসব উপজেলায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে যাচ্ছে সেগুলো হচ্ছে নেত্রকোনা সদর ও কেন্দুয়া, নীলফামারী সদর, জামালপুরের সদর, সরিষাবাড়ী, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, রাজশাহীর বাঘা ও মোহনপুর, পঞ্চগড়ের বোদা, জয়পুরহাটের সদর ও পাঁচবিবি, সিরাজগঞ্জের সদর, উল্লাপাড়া ও কাজীপুর, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম এবং নাটোর সদর।

এদিকে দ্বিতীয় ধাপের ১২৪টি উপজেলার নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল গত সোমবার। এর মধ্যে ১২টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। এই ধাপের মনোনয়ন যাচাই-বাছাই হবে আজ। মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ২৭ ফেব্রুয়ারি। বাছাই ও প্রত্যাহারের পর এই ধাপেও একক প্রার্থীর সংখ্যা বাড়তে পারে।

প্রথম পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ১২টি জেলার মধ্যে ৮টি জেলা উত্তরবঙ্গের। এসব জেলায় জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক ভিত্তি ভালো। তাই প্রথম পর্যায়ের নির্বাচনে জাপার প্রার্থীরা অধিকাংশ উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সব জেলায় জাপার প্রতিদ্বন্দ্বিতা না–ও থাকতে পারে। তাই প্রথম ধাপের তুলনায় পরের চার ধাপে প্রতিযোগিতা আরও কমতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়

ইসি সূত্রে জানা যায়, জামালপুরের সরিষাবাড়ী, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও জয়পুরহাট সদর উপজেলায় শুরুতে একজন করে প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। গতকাল অন্য ১৩টি উপজেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী বাদে অন্যরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক রিয়াজ উদ্দিন, উল্লাপাড়ায় সাবেক সাংসদ গাজী শফিকুল ইসলাম ও কাজীপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান সিরাজী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।

নাটোর সদর চেয়ারম্যান পদে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। তিনি বর্তমান চেয়ারম্যান। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী মোস্তারুল আলম মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন।

জয়পুরহাট সদরে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এস এম সোলায়মান আলী আর পাঁচবিবি উপজেলায় মনিরুল শহীদ ছাড়া অন্য প্রার্থীরা গতকাল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন।

নেত্রকোনায় নয়টি উপজেলার দুটিতে আওয়ামী লীগের দুজন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। তাঁরা হলেন সদর উপজেলার অধ্যাপক তফসির উদ্দিন খান ও কেন্দুয়া উপজেলার নুরুল ইসলাম। তফসীর জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির সহসভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। আর নুরুল ইসলাম কেন্দুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এই দুই উপজেলার চেয়ারম্যান পদের অন্য প্রার্থীরা গতকাল তাঁদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন।

নীলফামারী সদরে জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিদ মাহমুদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।

রাজশাহীর বাঘায় জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লায়েব উদ্দীন ও মোহনপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুস সালাম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন।

 দলের নির্দেশ অগ্রাহ্য

দলের নির্দেশ অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এরপরও প্রথম ধাপে অধিকাংশ উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়িয়ে আছেন। অবশ্য দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনে গতকাল কয়েকটি উপজেলায় বিদ্রোহীরা বসে যান।

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন চারজন। তাঁরা হলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল মালেক চিশতী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান পরিমল দে সরকার, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা পরিষদ সদস্য হারুন উর রশিদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোখলেছুর রহমান শাহ। এই উপজেলায় আওয়ামী লীগ মনোনিত প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাসনাৎ জামান চৌধুরী (জর্জ)।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশে আওয়ামী লীগের প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিত কুমার কর্মকার। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তাড়াশ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. মনিরুজ্জামান এবং উপজেলা যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি মীর মো. শহিদুল ইসলাম।

নাটোরের গুরুদাসপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহেদুল ইসলাম। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন।

বড়াইগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক এবং বর্তমানে চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন।

জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোস্তাকিম মণ্ডল দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান তাইফুল ইসলাম তালুকদার। আক্কেলপুরে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন মোখছেদ আলী মাস্টার। বিদ্রোহী প্রার্থী আওয়ামী লীগের আবদুস সালাম আকন্দ।

নীলফামারীর ডোমারে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তোফায়েল আহমেদ। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বসুনিয়া।

জলঢাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনছার আলী। বিদ্রোহী প্রার্থী উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ।

কিশোরগঞ্জে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন। বিদ্রোহী প্রার্থী গারাগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বিপ্লব কুমার সরকার এবং উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আবুল কালাম।

জামালপুরের ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জে দুজন করে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। ইসলামপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জিয়াউল হক ও দেওয়ানগঞ্জে উপজেলা আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক সোলাইমান হোসেন বিদ্রোহী হয়েছেন।

কুড়িগ্রামের রাজারহাটে বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক রংপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জাহিদ সোহরাওয়ার্দ্দী, উলিপুরে প্রজন্ম লীগের নেতা সাজাদুর রহমান, ফুলবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, সদর উপজেলায় সাইদুল হাসান, রৌমারীতে উপজেলা বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি শেখ আবদুল্লাহ এবং রাজিবপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকবর হোসেন।

বিএনপির প্রার্থী

একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যানের পর বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০–দলীয় জোট। জোটের সিদ্ধান্ত না মেনে প্রথম পর্যায়ের ১৬টি উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির তৃণমূলের নেতারা। বিএনপির বর্তমান চেয়ারম্যানদের মধ্যে তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রায় অর্ধেক উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যানের দুটি পদে অংশ নিচ্ছেন দলটির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দোয়ারাবাজার ও বিশ্বম্ভরপুর, সিরাজগঞ্জের চৌহালী, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ, জামালপুরের বকশীগঞ্জ ও ইসলামপুর, হবিগঞ্জের বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ, চুনারুঘাট ও মাধবপুর, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী ও রৌমারী, পঞ্চগড় সদর ও তেঁতুলিয়া উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বিএনপির স্থানীয় নেতারা।

হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক খালেদুর রশিদ, বানিয়াচংয়ে জেলা বিএনপির সহসভাপতি মঞ্জুর উদ্দিন, চুনারুঘাটে উপজেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ লিয়াকত হোসেন এবং মাধবপুরে বর্তমান চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি সৈয়দ মো. শাহজাহান মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে জেলা বিএনপির সহসভাপতি আনিসুল হক, দক্ষিণ সুনামগঞ্জে জেলা বিএনপির সহসভাপতি ফারুক আহমদ, বিশ্বম্ভরপুরে উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ এবং দোয়ারাবাজারে উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ লড়ছেন।

নীলফামারীর ছয় উপজেলার মধ্যে শুধু কিশোরগঞ্জে বিএনপির একজন প্রার্থী রয়েছেন। তিনি জেলা ওলামা দলের সভাপতি আ ন ম রুহুল ইসলাম।

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে বিএনপির সভাপতি গোলাম রসুল রানা এবং রৌমারী উপজেলায় ইমান আলী বিএনপির প্রার্থী।

জামালপুরের বকশীগঞ্জ ও ইসলামপুরে বিএনপির সাবেক দুই নেতা চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন। বকশীগঞ্জের বর্তমান চেয়ারম্যান ও সাবেক উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবদুর রউফ তালুকদার এবং ইসলামপুরে বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান জাতীয় পার্টি থেকে লড়ছেন।

জোটের সিদ্ধান্ত না মেনে কিছু নেতা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় অস্বস্তিতে পড়েছে বিএনপি। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, দলের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের কাছে এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন আসার পর বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।