সত্য উদ্ঘাটনে এই বইয়ের রয়েছে বড় ভূমিকা

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যে বিপুল অভিঘাত তৈরি করেছিল বাঙালি জাতির মানসে, তার সুফল আমরা নানাভাবে ভোগ করি। তবে এই অর্জনের জন্য যে কতভাবে আমাদের লড়তে হয়েছে সেই বিস্তার ও গভীরতা যথাযথভাবে উপলব্ধ হয়েছে বলা যাবে না। একুশের আন্দোলনের ইতিহাস প্রণয়নও ছিল তেমনি এক লড়াই, যা কখনোই নিছক অ্যাকাডেমিক ইতিহাসচর্চার বিষয় ছিল না, ছিল আরেক সংগ্রামেরই পরিচয়। ভাষা আন্দোলনের পরের বছরই সমকালীন ঘটনার ঐতিহাসিক ভাষ্য রচনার সমবেত প্রয়াস হিসেবে নিবেদিত হয় সংকলনগ্রন্থ হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী, যা প্রকাশিত হলেও প্রচারিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। প্রেস থেকেই গ্রন্থের বাঁধাই কপি ও অবাঁধাই ফর্মা পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে নেয় রাতারাতি। এমন নানা বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও যে একুশের আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে, তার পেছনে ছিল বৃহত্তর আর্থসামাজিক পটভূমি, সেই সঙ্গে বহু মানুষের বহুমুখী অবদান। এ ক্ষেত্রে একুশের প্রামাণ্য ইতিহাস প্রণয়ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল এবং এই গুরুত্ব ক্রমে আরও প্রসারিত হয়ে চলেছে।

উপরিউক্ত পটভূমিকায় একুশের গ্রন্থমালায় আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক প্রণীত ভাষা আন্দোলন: ইতিহাস ও তাৎপর্য পালন করেছে বিশেষ ভূমিকা। গ্রন্থকারদ্বয় বায়ান্নর আন্দোলনে পালন করেছেন বিশেষ ভূমিকা, আবদুল মতিন ছিলেন নেতৃত্বের কাতারে এবং আহমদ রফিক মেডিকেল কলেজের ছাত্র হিসেবে নেপথ্যে, তবে প্রায় প্রতিটি ঘটনার সাক্ষী ও পর্যবেক্ষক হিসেবে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রণীত গ্রন্থসমূহে তথ্যের বিভ্রা​ন্তি, বিশেষভাবে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধাদিতে বিভ্রমের বিস্তার লেখকদ্বয়কে পীড়িত করেছিল এবং এ নিয়ে আহমদ রফিকের উদ্বেগ ছিল সমধিক। কেননা, তিনি পেশায় চিকিৎসক হলেও ক্রমে হয়ে উঠেছিলেন লেখক, চিকিৎসক ও ইতিহাসের ব্যাখ্যাতা। এই লেখকই আন্তর্তাগিদ থেকে ভাষা আন্দোলনের তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস প্রণয়নে লড়াইয়ের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব আবদুল মতিনকে কর্মসহযোগী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। দুই শতাধিক পৃষ্ঠার গ্রন্থের বড় অংশজুড়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত হয়েছে ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের ঢাকার জনসভায় উদু​র্কে রাষ্ট্রভাষা করবার পক্ষে জোর ঘোষণার প্রতিবাদ, একুশে ফেব্রুয়ারির মহাবিস্ফোরণ এবং পরবর্তী ঘটনাধারা। রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ইত্যাদি বিভিন্ন গোষ্ঠীর অবস্থান, তাদের ভেতরকার বিন্যাস ও দ্বন্দ্ব, সভা-সমাবেশের দিনক্ষণ ও সিদ্ধান্ত ইত্যাদি বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে লেখকদ্বয় ইতিহাসের সত্যরূপ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। এর বিভিন্ন উদাহরণ, কিংবা বিভিন্ন লেখকের বক্তব্য খণ্ডনের প্রয়াস আমরা এখানে তুলে করছি না, তবে এ কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায় একুশের আন্দোলন বিষয়ে নানা তথ্যের ভিড় থেকে প্রকৃত সত্য উদ্​ঘাটনে এই গ্রন্থ পালন করেছে বড় ভূমিকা।

এ ক্ষেত্রে এটাও আমাদের স্মরণে রাখতে হয়, ইতিহাসের ঘটনা ও মূল্যায়ন এক সদা প্রসারমাণ প্রপঞ্চ, এখানেই ইতিহাসচর্চার প্রাসঙ্গিকতা ও সার্থকতা। নতুনতর তথ্য এবং নবদৃষ্টিকোণ পুরোনোকে ছাপিয়ে উঠলেও কোনো কোনো ইতিহাসগ্রন্থ থাকে, যা হয়ে ওঠে কালজয়ী; কেননা, ইতিহাসের পাঠগ্রহণে মাইলফলকের মতো তা জেগে থাকে, যা পথ দেখায় সামনে এগিয়ে চলবার। আবদুল মতিন ও আহমদ রফিকের গ্রন্থ সেই মর্যাদায় অটুট থাকবে বটে, তবে সেই সঙ্গে নতুন তথ্য সংযোগ ও নতুন বিচারের তাগিদ তো অস্বীকার করবার নয়। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে শহীদ রফিক ও শহীদ সালাউদ্দিনের পরিচয় ঘিরে গোলাম কুদ্দুছের সাম্প্রতিক গবেষণায় উদ্​ঘাটিত পরিচয়। এই গবেষণা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যবিভ্রম ঘুচাতে সহায়ক হবে নিঃসন্দেহে এবং আলোচিত গ্রন্থে নতুন তথ্যের স্বীকৃতি তা দাবি করে।

তবে ভাষা আন্দোলনে বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজ নিজ অবদান নিয়ে সেসব দাবি উত্থাপন করেছে, সে​ ক্ষেত্রে বিভ্রম ঘোচানো সহজ কাজ নয়। ১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের তাণ্ডবের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তি তখনো খুব সংহত হয়ে উঠতে পারেনি। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলেও দেশজুড়ে সাংগঠনিক বিস্তার তৈরি করতে পারেনি, কমিউনিস্ট পার্টি সরকারি পীড়ন, নিজেদের অতিবিপ্লববাদ এবং ’৫০ সালের দাঙ্গার ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। পার্টি-প্রভাবিত ছাত্র ফেডারেশনও একই সংকটে পীড়িত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ দেশব্যাপী সাংগঠনিক ভিত্তি পেলেও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ কারাবাসের কারণে সাংগঠনিক নেতৃত্ব হারিয়েছিল। তারপরও যে ভাষা আন্দোলন অমন দুর্বার হয়ে উঠতে পেরেছিল, তার পেছনে যেমন বিভিন্ন সাংগঠনিক গোষ্ঠীর ভূমিকা ছিল, তেমনি ছিল এর স্বতঃস্ফূর্ততা। তবে ছাত্র-যুবসমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণ যে আন্দোলনের চরিত্র পাল্টে দিয়েছিল এবং প্রকৃত জাতীয় আন্দোলনে রূপান্তরের ভিত্তি তৈরি করেছিল, সেটা গ্রন্থের ইতিহাস পর্যালোচনায় বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা নিয়েও নতুন পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষভাবে অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং পুলিশ রেকর্ডের সংকলন প্রকাশের পর এটা স্পষ্ট হয়েছে যে সেই সময়ে তরুণদের নেতা হিসেবে গণ্য এই ব্যক্তিত্বের ভূমিকা, বিশেষভাবে নিরাপত্তা বন্দী হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজে তাঁর কেবিনে নাজিমউদ্দিনের ভাষণ-পরবর্তী সভা খুবই গুরুত্ব বহন করে। এই সভার তাৎপর্য লঘু করা কিংবা অস্বীকারের অনেক চেষ্টা হয়েছে, এখন মনে হচ্ছে, এই অধ্যায়ের পুনর্লিখনও প্রয়োজন রয়েছে। এখানেই নিহিত আছে ইতিহাসের চ্যালেঞ্জ ও মাধুর্য। ইতিহাস অধ্যয়ন-অনুশীলন নতুন তথ্য আকর্ষণ করে এবং নব-উদ্ভাসন দাবি করে নববিবেচনা, এসবই ঘটে অতীত কাজের ভিত্তিতে, যে কাজ অসাধারণভাবে সম্পন্ন করেছেন আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক।

● ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাৎপর্য আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক, সাহিত্যপ্রকাশ