'ভুলো না আমায়'

রফিকউদ্দিন আহমেদ
রফিকউদ্দিন আহমেদ

এক টুকরো সাদা কাপড়ের ওপর রঙিন সুতো দিয়ে সুইয়ের ফোঁড় তুলে রাহেলা খাতুন লিখছিল—‘ভুলো না আমায়’। কাপড়ের চার কোণে ফুলের নকশা তুলেছে। এখন পর্যন্ত ‘ভুলো...’ শব্দটি লেখা শেষ করেছে মাত্র, অমনি আম্মা ডাক পাড়ল, ‘কি রে পানু, ঘর থেইক্যা বাইরাবি না আইজ? বেলা উঠল মাথায়, গরু দুইটা না খাইয়া থাকব? আমি একা তো পারি না আর...।’

তাড়াতাড়ি নকশা তোলা কাপড় আর সুই-সুতা চাপা দিল বালিশের নিচে। খাট থেকে নেমে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বাইরে তখন সুন্দর ঝকঝকে সকাল। মন উতলা করা হালকা শীতের হাওয়া। এখন কী মাস যেন? ফাল্গুন। তাই তো বলি, পুকুরঘাটের পলাশগাছটার ডালে এমন থোকা থোকা লাল রঙের বাহার এল কী করে! দূরে কোথাও একটা কোকিল ডাকছে অবিরাম। সেই সুর এত দূরে এসেও বুকে লাগে রাহেলার।

‘আচ্ছা কোকিল এমুন কইরা ডাহে ক্যান বুবু?’

‘কেমুন কইরা?’—বলে তার দিকে কেমন হাসি-কৌতুকের দিকে দৃষ্টিতে তাকায় হাসু বুবু।

হাসু বুবুর সঙ্গে ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছিল উত্তর পাড়ার আরও দুটি মেয়ে, তারাও হাসে। যেন কী এমন হাসির কথা বলেছে সে। কোনো উত্তর দিল না। হাসু বুবু এবার বলল, ‘বুবু রে পাখি তো ডাহে পাখির মতো, তয় সেই সুর শুইনা কইলাম হগলের মন উতলা অয় না, যার হওয়ার তার অয়।’

এই সব মারফতি লাইনের কথা বোঝে না পানু। তবে এটা বোঝে, কদিন ধরে পলাশ-শিমুলের রং, ফাগুন হাওয়া আর কোকিলের ডাকে যেন তার মনের ভেতর কিসের একটা তোলপাড়। কেন কে জানে। হাসু বুবু জানে—বলল, ‘বুঝস না, ভালোবাসার মানুষের লগে বিয়া ঠিক অইছে, দুই দিন পর মেহেদি লাগব হাতে, তর মন তো অহন পাখির ডাকে, ফুলের বাসে একটু আনচান করবই।’

কথা ঠিক। পারিল গ্রামটা যে এত সুন্দর আগে কখনো এমন করে বুঝতে পারেনি। সেদিন কুলসুমদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় সবুজ খেতের বুক চেরা মেঠো পথ দিয়ে হাঁটার পথে, জোড়দিঘির পাড়ের বাঁশঝাড় ফেলে আসার সময় অশৈশব চেনা গ্রামটিকে যেন নতুন করে চিনেছিল। মনে হয়েছে, এমন ছবির মতো সুন্দর গ্রাম বোধ হয় পৃথিবীতে আর নেই।

আজকের মতোই ধীর-মন্থর হাওয়া এসে লাগছিল গায়ে। আর হাসু বুবু যে বলল ‘আনচান’ করা, সে রকমই কিছু একটা ভর করেছিল শরীর ও মনে।

আসলে কটা দিন রফিককে না দেখলেই এখন মনটা কেমন করে। সব কিছুই আছে, তবু কী যেন নেই। লোকটা এখন প্রায়ই ঢাকা শহরে থাকে। পানুর দিন কাটে তার পথ চেয়ে।

সেই ছোটবেলায়, যখন ছেলেদের ডাংগুলি খেলার বয়স আর মেয়েরা চি-কুত কুত খেলে, তখন থেকেই একই গাঁয়ের ছেলে সম্পর্কে চাচাতো ভাইটাকে ভালো লেগে গিয়েছিল পানুর। কিন্তু রফিক তেমন পাত্তা দিত না। ডানপিটে ছিল তো খুব। কোন মেয়েটার তাকে ভালো লাগে, সেটা বোঝার সময় কোথায়। সারা দিন কাটাত তার দুরন্তপনার মধ্যে। একবার তো আমগাছ থেকে পড়ে হাত ভেঙে ফেলেছিল। গ্রামে ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েও হাত আর জোড়া লাগে না। শেষে কলকাতায় পাঠানো হলো। তখন রফিকের বাবা আবদুল লতিফ মিয়া থাকতে কলকাতায়, ব্যবসা করত। চিকিৎসা করতে গিয়ে আর ফেরে না রফিক।

প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে সূর্য ডোবে রক্তপাতে। দিন যায়, মাস যায় কিশোরী রাহেলার অপেক্ষা আর ফুরায় না। একদিন জানতে পারল, চিকিৎসা হয়েছে, ভাঙা হাত জোড়াও লেগেছে। কিন্তু রফিক আর ফিরবে না। সেখানেই স্কুলে ভর্তি হয়েছে, মিত্র ইনস্টিটিউশনে। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই দীর্ঘশ্বাস বুকে চাপা না রেখে উপায় কী। এই বয়সের পুঁচকে মেয়ে কার কাছে বলতে যাবে তার গোপন ভালোবাসার কথা। কারও কাছে বলতে পারেনি, কিন্তু নিয়তি বোধ হয় শুনেছিল সেই অব্যক্ত বেদনা। দেশভাগের দাঙ্গা-হাঙ্গামার পর বাবার সঙ্গে কলকাতা থেকে ফিরে এল রফিক। সেটা ১৯৪৭ সাল। দেশে ফিরে বাড়ি থেকে সাত মাইল দূরে বায়রা উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। সেই স্কুলে থেকে ম্যাট্রিকুলেশনও পাস করে ফেলল। সেটা ১৯৪৯ সাল।

এত দিন পর যেন খেলার সাথী পানুর দিকে তাকানোর সময় হলো রফিকের। মেয়েটির চোখের মুগ্ধতার ভাষা পড়তে শিখে গেছে ছেলেটি। মানিকগঞ্জের পারিল গ্রামের দুই কিশোর-কিশোরী বাঁধা পড়ে গেল ভালোবাসার বন্ধনে।

রফিক ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হলো। সেখানে হোস্টেলে থাকে, কদিন পরপরই গ্রামে আসে। চলছিল বেশ। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাকে চলে যেতে হলো ঢাকায়। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় রফিককে তাঁর বাবা ঢাকা নিয়ে গেলেন তাঁর প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসা দেখাশোনা করার জন্য। আবার বিরহের বেদনা ভর করল বুকে। তবে সান্ত্বনা এইটুকু, ঢাকা শহর অনেক দূরের কোনো দেশ তো নয়। মাঝেমধ্যেই গ্রামে আসা-যাওয়া করতে পারে রফিক। একদিকে ব্যবসার দেখাশোনা, অন্যদিকে লেখাপড়াটা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ঢাকায় জগন্নাথ কলেজের নাইট শিফটের ছাত্র হিসেবে নাম লেখাল সে।

রাহেলা নিজে লেখাপড়া করেছে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। সাধ্যমতো মনের অনুভূতি জানিয়ে চিঠি লিখত রফিকের কাছে। উত্তর দিত রফিক। অনুরাগে সিক্ত চিঠি। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা আর গোপন থাকল না। তবে রাহেলা-রফিকের পরিবারেও এ নিয়ে খুব একটা ওজর আপত্তি নেই। রফিকের মা রাফিজা খাতুন বড় স্নেহ করত সুন্দর চেহারার লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটিকে। এমন মেয়েকে ঘরের বউ করে তুলে আনবে, এটা ভেবে খুশিতে মন ভরে যায় তার। রাহেলার মা-বাবাও ভাবে, ছেলে তো ভালো, একই গ্রামের ছেলে, লেখাপড়ায় অনেকটা এগিয়েছে, ব্যবসাপাতিও করছে। মেয়ের জন্য এর চেয়ে ভালো পাত্র আর কোথায় খুঁজতে যাবে। অবশেষে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ের দিন–তারিখও ঠিক হলো। পান-চিনির অনুষ্ঠানটাও হয়ে গেল ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ। সেটা ১৯৫২ সাল।

এদিকে ঢাকায় নাকি তখন খুব ‘গন্ডগোল’ হচ্ছে। গ্রামের লোকজন বলে ‘গন্ডগোল’, রফিক বলে ‘আন্দোলন’। অল্প শিক্ষিত গ্রামের মেয়েটি সব কথা বুঝতেও পারে না। রফিক তাকে বলেছে, ‘আমরা বাংলার মানুষ, বাংলা ভাষায় কথা বলি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা বলছে উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা। আমার দেশে আমার ভাষার এমন অপমান কী সহ্য করা যায়!’— রফিকের কথার সবটা বুঝতে না পারলেও তার মনের জোরটা ধরতে পারে। তার চোখে-মুখে একটা উত্তেজনার দীপ্তিও দেখতে পায় সে।

দেশ নিয়ে, দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে অনেক কিছুই ভাবে রফিক। রাজনীতিও করে এক-আধটু। বায়রা স্কুলে পড়ার সময় ‘লিডার’ বনে গিয়েছিল। এই ‘রাজনীতি’ শব্দটা কেন জানি অজানা আশঙ্কা জাগিয়ে তোলে রাহেলার মনে। বারবার রফিককে বলেছে, কী দরকার এইসব প্যাঁচের মধ্যে যাওয়ার। রফিক বলে, ‘প্যাঁচ না রে পানু, পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর জুলুম করতাছে। আমাদের দেশের সম্পদ নিয়া তাদের দেশটারে বেহেশত বানাইতেছে। আর আমরা এহানে মরতাছি না খাইয়া। এই জন্য পাকিস্তান হইসিল? এহন আবার কয় রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। ক্যান আমাদের ভাষাটা কি ফ্যালনা?’

এসব কথার উত্তর তো জানা নেই গ্রাম্য মেয়েটির। সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার প্রিয় মানুষটির দিকে। তার দৃঢ় চোয়ালের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো সত্য মনে হয়।

এবার ঢাকা যাওয়ার সময় বলে গেল, ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ বাড়ি ফিরবে। বিয়ের শাড়ি-গয়না, বাজার-সদাইও করে নিয়ে আসবে। রাহেলা অপেক্ষার দিন গুনছিল, আর সাদা কাপড়ে রঙিন সুতোর নকশা দিয়ে সেলাই করছিল—‘ভুলো না আমায়’। রফিক ফেরার আগেই সেলাইয়ের কাজ শেষ করতে হবে। তারপর কাচের ফ্রেমে বাঁধাই করবে। ঝুলিয়ে রাখবে তাদের নতুন ঘরের দেয়ালে।

২.

ভোর থেকেই কী এক উত্তেজনা ভর করেছিল রফিকের মনে। ঢাকা শহরের অবস্থা খুব খারাপ। প্রতিদিন চলছে ছাত্রদের মিছিল, সভা-সমাবেশ। এসব ঠেকাতে এবার ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সভা-সমাবেশ-মিছিল সব নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু ছাত্র-জনতার মনে যে আগুন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তা নিভবে না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার সম্মান দিতেই হবে।

বিয়ের বাজার–সদাই করে বাড়ি ফেরার কথা ছিল আজ। পানুর পানপাতার মতো সুন্দর চেহারাটাও চোখে ভাসছিল তার, বিদায় নিয়ে আসার সময় মেয়েটির ডাগর চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু দেখে এসেছিল। সে যখন শাড়ি-গয়না নিয়ে ফিরবে, তখন সেই চোখ কেমন আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে, সেটাও যেন দেখতে পাচ্ছিল কল্পনায়। কিন্তু ভাষার দাবিতে ছাত্র-জনতার মধ্যে যে ক্ষোভ ও দ্রোহ, সেটাও তো সঞ্চারিত হয়েছে মনে। এই মুহূর্তে নিজের ভালোবাসার মানুষটির কথা ভাবার চেয়েও দেশের কথা, মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষার কথা ভাবতে হবে আগে।

বাবা বিয়ের আয়োজন করতে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে আগের দিন। এতে সুবিধাই হলো। প্রেসেরই একটি কামরায় বাপ-ছেলে রাত কাটায়। কোথাও বেরুবার সময় বাবাকে জানিয়ে যেতে হয়। আজ জিজ্ঞেস করার কেউ নেই।

ভোরের আলো ভালো করে ফোটার আগেই বেরিয়ে পড়ল রফিক। রমনায় গিয়ে দেখল, সেখানে আগে থেকেই জড়ো হয়েছে শত শত ছাত্র-জনতা। সবারই চেহারা নির্ভয়, সংকল্পে অটল।

নেতা গোছের কেউ একজন বক্তৃতা দিচ্ছে সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে। মাইক্রোফোন নেই, কিন্তু জ্বালাময়ী কণ্ঠে বলা তার কথাগুলো যেন আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে সকলের মনে— ‘দুই হাজার কিলোমিটার দূরের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেউ যদি এসে বলে, তোমরা আমাদের ভাষায় কথা বলবে। অফিস-আদালতে আমাদের ভাষায় কাজকর্ম চলবে..., এটা কি আমরা মানতে পারি?’

‘না’—সহস্র কণ্ঠে ধ্বনিত হলো প্রবল প্রতিবাদ।

‘আমরা আমাদের মায়ের ভাষাকে এভাবে অপমানিত হতে দেব না। উর্দু নয়, বাংলা হবে আমাদের রাষ্ট্র ভাষা।’

চারদিক থেকে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হাজার কণ্ঠের স্লোগান উঠল—‘রাষ্ট্র ভাষা রাষ্ট্র ভাষা, বাংলা চাই বাংলা চাই।’

রক্তে জেগে উঠল প্রলয়দোলা। মিছিলে বেরিয়ে পড়ল রফিকউদ্দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল নিয়ে এসেছে মেডিকেল হোস্টেলের সামনে। পুলিশের লাঠি, টিয়ার গ্যাস কিছুই আজ মানছে না মানুষ। অপ্রতিরোধ্য জনতার মিছিলে এগিয়ে যাচ্ছে রফিক। আকাশের দিকে তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত। শুরু হয়ে গেছে গুলি। ছত্রভঙ্গ মিছিল। হঠাৎ কানের পাশে এসে লাগল তীব্র আগুনের হল্কা। দুলে উঠল পৃথিবী। পারিল গ্রামের নূরানী নদীর তীর থেকে যেন উড়াল দিয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি...। রাফিজা খাতুন চিৎকার করে ডাকছেন, রফিক, বাবা রফিক...। রফিক ডাকতে চায়, মা...। কিন্তু নূরানীর নদীর স্রোত, জলের কলধ্বনি থমকে গেছে। পানপাতার মতো সুন্দর মুখটি একবার চোখের সামনে ভাসে, তার ডাগর চোখের বাঁকে অশ্রুবিন্দু। রফিক বলতে চায়, পানু...। কিন্তু তার মুখের ভাষা স্তব্ধ হয়ে যায় কোটি বাঙালির মুখে মুখে চিরকাল বেঁচে থাকবে বলে। সেটা ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সাল।