কীভাবে আগুনের সূত্রপাত?

ধ্বংসস্তূপে রিকশা। ছবি: আসাদুজ্জামান
ধ্বংসস্তূপে রিকশা। ছবি: আসাদুজ্জামান

চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ে অগ্নিকাণ্ডের ঠিক আগমুহূর্তে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনেছিলেন আশপাশের লোকজন। মুহূর্তেই রাস্তায় যানজটে আটকে থাকা যানবাহন এবং আশপাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়ে লকলকে আগুন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, পুরো ঘটনাটি মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটেছে।

বুধবার রাতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত কী—সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে তিন ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন ঘটনার সময় আশপাশে থাকা লোকজন। তবে ফায়ার সার্ভিস বলছে, আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। এ জন্য তদন্ত কমিটি কাজ করছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনাস্থলের আশপাশের বাসিন্দাদের একটি দল বলেছে, মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পিকআপের সিএনজি সিলিন্ডার হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়। এতে পিকআপটি আট-দশ ফুট ওপরে উঠে যায়। এরপর আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আরেক দল বলছে, আগুনের সূত্রপাত ঘটে আটকে থাকা অন্য আরেকটি পিকআপের সিএনজি সিলিন্ডার থেকে। ওই পিকআপ গ্যাসের সিলিন্ডার বহন করছিল। তৃতীয় দলটি বলছে, মোড়ে থাকা একটি বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার থেকে আগুনের সূত্রপাত। তবে প্রত্যেকেই বলেছেন, আগুনের তীব্রতা বেড়েছে আশপাশের ভবনে থাকা সুগন্ধি কারখানা এবং প্লাস্টিক ও রঙের দোকানে থাকা রাসায়নিক দ্রব্যের জন্য।

চুড়িহাট্টা মোড়টিতে আশপাশ থেকে পাঁচটি রাস্তা এসে মিশেছে। ঠিক মোড়েই চুড়িহাট্টা জামে মসজিদ। এর দক্ষিণ দিকে একটি সড়ক চলে গেছে ডালপট্টির দিকে। মসজিদের পূর্ব দিকের নন্দকুমার দত্ত সড়কটি গিয়ে মিশেছে উর্দু রোডে। মসজিদের দক্ষিণ দেয়াল ঘেঁষে যে সড়ক, সেটি গেছে পোস্তার দিকে। মসজিদের উত্তরের দেয়াল ঘেঁষে শেখ হায়দার বক্স লেন গিয়ে উঠেছে লালবাগে। এর (শেখ হায়দার বক্স লেন) খানিকটা উত্তর পাশে শেখ আজগর লেন গিয়ে উঠেছে বকশীবাজারে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, বুধবার রাতে মোড়টি অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশিই ব্যস্ত ছিল। একুশে ফেব্রুয়ারির কারণে লালবাগ ও বকশীবাজার হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাওয়ার যান চলাচল বন্ধ থাকার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যে মুহূর্তে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে, তখন জটের কারণে মোড়ে যানবাহন একেবারে থমকে ছিল। আগুন নেভানোর পর চুড়িহাট্টার ছোট্ট মোড়টিতে দুটি পিকআপ, দুটি প্রাইভেট কার, ১১টি মোটরসাইকেল, অন্তত ২০টি রিকশা, ভ্যান ও অটোরিকশার ধ্বংসাবশেষ পড়ে ছিল।

পিকআপ থেকে আগুন?
স্থানীয় যুবক মো. আশিক উদ্দিনের দাবি, অগ্নিকাণ্ড শুরু হওয়ার সময় তিনি ঘটনাস্থল থেকে ২৫-৩০ গজ দূরে নন্দকুমার সড়কে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বুধবার রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাকিয়ে দেখেন, মোড়ের হাজি ওয়াহেদ ম্যানসনের সামনে আগুন ধরে যাওয়া একটি পিকআপ আট-দশ ফুট ওপর থেকে নিচে পড়ছে। এরপরই সেই আগুন পাশে থাকা রাজমহল হোটেলের সামনে থাকা তিনটি গ্যাস সিলিন্ডারে ধরে যায়। একটি সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে ঢুকে যায় উল্টো পাশের হজরত আনাস (রা.) হোটেলে।

তবে রাজমহল খাবার হোটেলের ব্যবস্থাপক মো. রাকিবের দাবি, তাঁদের হোটেলে আগুন লেগেছে কমপক্ষে ১০ মিনিট পর। এর মধ্যে তাঁরা হোটেলের সব লোককে বের করে দেন। পরে তাঁরাও বেরিয়ে যান।

বৃহস্পতিবার সকালে দেখা যায়, রাজমহল হোটেলটির সামনের কিছু অংশ পোড়া, তবে ভেতরের চেয়ার টেবিল অক্ষত ছিল। আনাস হোটেলটি বন্ধ দেখা যায়। এর ব্যবস্থাপক রেজাউল হাসান বলেন, হোটেলের আসবাবের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।

আগুনে জ্বলে চুড়িহাট্টা গলি। ছবি: আসাদুজ্জামান
আগুনে জ্বলে চুড়িহাট্টা গলি। ছবি: আসাদুজ্জামান

গ্যাস সিলিন্ডার থেকে সূত্রপাত?
ঘটনাস্থলে জড়ো হওয়া আশপাশের ব্যবসায়ী ও বাড়ির মালিকদের একটি বড় অংশের দাবি, আগুন লাগে যানজটে আটকে থাকা গ্যাসের সিলিন্ডারবাহী একটি পিকআপ থেকে। যদিও বৃহস্পতিবার সেখানে বিস্ফোরিত সিলিন্ডারের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়নি।

চুড়িহাট্টা মোড়ে থাকা দুটি পিক আপ ও দুটি প্রাইভেট কারের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে একটি প্রাইভেট কারে সিএনজি সিলিন্ডার দেখা গেছে। সিলিন্ডারটি অক্ষত ছিল। অন্য তিনটি গাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও তাদের কাঠামো অক্ষত ছিল।

তবে সেলিম হাসান নামের এলাকার এক দোকানি প্রথম আলোকে বলেন, হাজি ওয়াহেদ ম্যানসনের সামনে থাকা পিকআপে সুগন্ধির বোতল ছিল। সেখান থেকে সুগন্ধির বোতল নামিয়ে ওয়াহেদ ম্যানসনের উল্টো পাশের ভবনে ঢোকানো হচ্ছিল। পিকআপটিতে আগুন লাগার পর সুগন্ধির বোতল বিস্ফোরিত হতে থাকে।

মোড়ে কোনো ট্রান্সফরমার নেই
বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে—স্থানীয় ব্যক্তিদের কেউ কেউ এমন দাবি করলেও চুড়িহাট্টা মোড়ে কোনো ট্রান্সফরমার নেই বলে জানান ডিপিডিসির কর্মীরা। বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে ডিপিডিসির কর্মী মোবারক (লাইনম্যান) বলেন, চুড়িহাট্টা মোড় থেকে একটু দূরে মসজিদের উত্তর কোনায় একটি ট্রান্সফরমার রয়েছে। এটি এখনো অক্ষত। তবে ওই মোড় দিয়ে ১১ হাজার ভোল্ট বিদ্যুতবাহী তার গেছে।

ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে পুড়ে অঙ্গার পিকআপ। ছবি: আসাদুজ্জামান
ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে পুড়ে অঙ্গার পিকআপ। ছবি: আসাদুজ্জামান

ওয়াহেদ ম্যানসনে রাসায়নিকের গুদাম
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, চারতলা ওয়াহেদ ম্যানসনই আগুন ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ। ভবনের দোতলার পুরোটা জুড়ে সুগন্ধি ও বাল্বের গুদাম। তিনতলার তিনটি ফ্ল্যাটে ভাড়াটে থাকলেও, চতুর্থ ফ্ল্যাটে গুদাম রয়েছে। চতুর্থ তলার দুটি ফ্ল্যাটই গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ভবনের নিচতলায় ১৫টি দোকান। এর মধ্যে কমপক্ষে ছয়টি দোকানে রাসায়নিকের ছোট ছোট ড্রাম ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, আগুন লাগার পর সুগন্ধির ছোট ছোট বোতল ‘গুলির মতো’ ছুটেছে।

ভবনটির নামকরণ করা হয়েছে ৬৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজি আবদুল ওয়াহেদের নামে। তাঁর মৃত্যুর পর ভবনটি দেখভাল করেন দুই ছেলে সোহেল ও হাসান। বৃহস্পতিবার তাঁদের ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে কথা বলতে তাঁদের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করলেও বন্ধ পাওয়া যায়।

ক্ষতিগ্রস্ত ছয়টি ভবনের তিনটিতেই ছিল দাহ্য পদার্থ
অগ্নিকাণ্ডে চারতলা ওয়াহেদ ম্যানসনের লাগোয়া একটি ছয়তলা ভবন পুরোপুরি পুড়ে গেছে। ছয়তলা ভবনটিতে আগুন নেভানোর কাজ করেছিলেন ফায়ার সার্ভিসের স্বেচ্ছাসেবক হাবিবুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ওই ভবনের চার, পাঁচ ও ছয়তলায় গুদাম ছিল। এগুলোতে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে।

ওয়াহেদ ম্যানসনের উল্টো পাশে একটি তিনতলা এবং এর লাগোয়া একটি চারতলা ভবনও পুড়ে গেছে। তিনতলা ভবনের মালিকের বোনের জামাতা শামীম আহমেদ ঘটনাস্থলে জানান, ভবনটির নিচতলার চারটি দোকানের মধ্যে দুটিতেই রাসায়নিক দ্রব্য ছিল।

এদিকে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করার পরও বৃহস্পতিবার বিকেল চারটায় ওয়াহেদ ম্যানসনের তিনতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে থেমে থেমে বিকট শব্দ আসছিল। জানালা দিয়ে আগুনের হলকাও দেখা যায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পানি দিয়ে পরে বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনেন।

পাশের হায়দার বকস লেনে আগেও আগুন লেগেছিল
মো. ফারুক নামে এক স্থানীয় প্লাস্টিক ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, ১৫-১৬ বছর আগে শেখ হায়দার বকস লেনের একটি রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ওই ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু হয়। আগুন নেভাতে গিয়ে মিরাজ নামে এক ব্যক্তি দগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর পুরো মুখ ঝলসে গিয়েছিল।

ফারুকের কথাকে সমর্থন করে হাজী ইসমাইল নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, এলাকার রাসায়নিক গুদামগুলোর কারণেই তাঁরা সব সময় ভয়ে থাকেন। নিমতলির ঘটনার পর এগুলো যদি সরিয়ে নেওয়া হতো, তাহলে এই ঘটনা ঘটত না।