পঙ্গু হাসপাতালে বন্ধ হচ্ছে না সেবা নিয়ে বাণিজ্য

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল)। ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল)। ছবি: সংগৃহীত

খেলতে গিয়ে পা ভেঙে যায় ৭ বছরের ছেলেটির। ১৫ দিন পর গত রোববার হাসপাতালে এলে চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে প্লাস্টার পরিবর্তনের কথা লিখে দেন। গৃহকর্মী মা ১ হাজার ৬০০ টাকা খরচ করে ছেলের প্লাস্টার পরিবর্তন করেন। কিন্তু প্লাস্টারের নিবন্ধন খাতায় ছেলেটির নাম নেই।

শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) বহির্বিভাগে এ ঘটনা ঘটেছে। গতকাল হাসপাতালের বহির্বিভাগে আড়াই ঘণ্টা অবস্থানকালে এ রকম বেশ কয়েকটি অনিয়মের চিত্র দেখা যায়।

অবশ্য বহির্বিভাগে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আগের তুলনায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি দেখা যায়। ড্রেসিংয়ের সময় রোগীকে জিম্মি করে টাকা নেওয়ার প্রবণতা কমেছে। বিষয়টি এখন ৫০ বা ১০০ টাকার বকশিশে সীমাবদ্ধ আছে। তবে দালাল ও হাসপাতালের কিছু কর্মী প্লাস্টার করার সময় নানা কায়দা করে রোগীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। দরিদ্র এবং পড়াশোনা না-জানা রোগীরা মূলত এর শিকার হচ্ছে।

বহির্বিভাগে লাল রঙের নোটিশ বোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা ‘প্লাস্টার বা ড্রেসিংয়ের জন্য কোনো টাকা দিবেন না।’ নোটিশ বোর্ডের পাশের ১৫ নম্বর কক্ষেই টাকার বিনিময়ে সেবা নিতে হয়েছে ওই ছোট্ট শিশুটির। শিশুটির মা প্রথম আলোকে জানান, চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হওয়ার পরে প্লাস্টার পরিবর্তন করাতে এক লোক তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্য বলেন। প্লাস্টার কক্ষের ভেতর থেকে বের হয়ে সেই লোক প্লাস্টারের খরচ বাবদ ১ হাজার ৬০০ টাকা নেন। এই শিশুটির বাবা পেশায় একজন নিরাপত্তাকর্মী। স্বামী-স্ত্রী দুজনের কেউই পড়াশোনা জানেন না। ঋণ করে ছেলের চিকিৎসার খরচপাতির জোগান দিতে হচ্ছে বলে জানান।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মাহফুজুল হক তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, কর্তৃপক্ষ প্লাস্টার সরবরাহ করলে এ সেবা পেতে কোনো টাকার দরকার হয় না। আর সরবরাহ না থাকলে প্লাস্টারের প্রয়োজনীয় উপকরণ রোগীকে কিনে আনতে হয়। তবে দীর্ঘদিন থেকে বহির্বিভাগে প্লাস্টার সরবরাহ বন্ধ আছে।

কর্তৃপক্ষ জানায়, গতকাল সকাল আটটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত এখানে ৫১ জনের প্লাস্টার করা হয়েছে। সেখানকার নিবন্ধন খাতায় শিশুটির নাম নেই। কোনো কর্মীর যোগসাজশে দালালেরা কাজটি করিয়ে থাকতে পারেন বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র স্টাফ নার্স। এই প্লাস্টারে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকার উপকরণ লাগতে পারে বলেও জানান তিনি।

আবার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময় হাত ভেঙে যায় পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নারীর। তিনিও গতকাল প্লাস্টার পরিবর্তনের জন্য আসেন। প্লাস্টার পরিবর্তন করতে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে নার্সেস স্টেশন থেকে একটি টোকেন লিখে দেওয়া হয়। সেখানে খরচ ৪০০ টাকা লিখে দেওয়া হলে এই নারী বলেন, এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য তাঁর নেই। তখন সেটা কেটে ১৫০ টাকা লিখে দেওয়া হয় বলে জানান এই নারী। অথচ এখান থেকে সিরিয়ালের জন্য কেবল টোকেন দেওয়ার নিয়ম। আবার টাকার বিনিময়ে সিরিয়াল আগ-পিছ করার সুযোগ আছে বলেও অভিযোগ রোগীদের।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, গত ৯ মে প্রথম আলোয় ‘পঙ্গু হাসপাতালে বিনা মূল্যের সেবায় পদে পদে টাকা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। তাতে বলা হয়েছিল, বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসা সব রোগীকে পদে পদে টাকা দিতে হয়। টাকা নেওয়ার অভিযোগ মূলত হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স, ওয়ার্ড বয়, আয়াদের বিরুদ্ধে।

সেই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। তারা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত স্টাফদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। টাকা লেনদেন বন্ধে রোগীকে সচেতন করে নোটিশ দিয়েছে। তারপরও বন্ধ হচ্ছে না সেবার বিনিময়ে লেনদেন।

প্রতারণার শিকার কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হলেই প্লাস্টারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করার কথা বলেন সেখানে উপস্থিত এক দল লোক। কেউ সঙ্গে গিয়ে প্লাস্টারের ব্যবস্থা করতে টাকা নেন। কেউবা পরামর্শ দেন ফটকের বাইরে একটি নির্দিষ্ট ওষুধের দোকান থেকে প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনার। জানা গেছে, রোগীদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপকরণ কিনতে বলা হয়। পরে ওই দোকানে সেসব উপকরণ ফেরত দেওয়া হয় অথবা অন্য রোগীদের প্লাস্টার করে টাকা নেওয়া হয়।

এসব অভিযোগের বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক মো. আবদুল গনি মোল্লা বলেন, হাসপাতালের বেশির ভাগ কর্মী এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নন। তবে কিছু কর্মী তো আছেনই, যাঁরা দালালদের সঙ্গে যোগসাজশে কিছু অনিয়ম করে থাকেন। আর হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণির লোকবলের ঘাটতি আছে বলেই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার সুযোগ থাকছে। তারপরও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।