মামলা দিতে গিয়ে অর্ধেক নারী-শিশু হেনস্তার শিকার

>
  • মামলা দিতে গিয়ে অর্ধেক নারী-শিশু হেনস্তার শিকার 
  • যথাযথভাবে মামলা গ্রহণ ৫৭.৭%
  • থানায় গিয়ে হয়রানির শিকার ২১.৭%
  • নিরুৎসাহিত করে কিন্তু মামলা নেয় ১৮.৩%
  • পুলিশের কটূক্তি শুনতে হয়েছে ৬.৩%
  • মামলা না করতে হুমকি ৪%

ধর্ষণের মামলা করতে গিয়ে প্রায় অর্ধেক নারী ও শিশু থানায় হেনস্তার শিকার হয়েছে। তাদের মামলা রেকর্ড হয়েছে হেলাফেলায়, টাকা খরচ করতে হয়েছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ আসামি ধরতে পারে না। আসামি ধরতে না পারার পেছনে পুলিশ রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় মাস্তান ও ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের দুষেছেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুলিশ স্টাফ কলেজের গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

‘কনভিকশন অব রেপ কেসেস: আ স্টাডি অন মেট্রোপলিটান সিটিজ অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি পুলিশ স্টাফ কলেজ সদর দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে। এতে থানায় যাওয়ার পর থেকে নারী ও শিশুরা বিচারের প্রতিটি ধাপে কী কী প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়, তা দেখানো হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে তদন্ত কার্যক্রমের ওপর। গবেষণার আওতাভুক্ত এলাকা হলো ছয় মহানগরের ২২টি থানা। এসব থানায় ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে হওয়া ৫৭৫টি মামলার এজাহার, ধর্ষণের শিকার ১৭৫ জন নারী ও শিশু এবং ১৯১ জন তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক মো. রেজাউল করিমের নেতৃত্বে তিনটি দলে চারজন করে তদন্ত কর্মকর্তা এবং একজন মাঠ তত্ত্বাবধায়ক গবেষণার কাজটি করেন। দলে ছয় মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন।

পুলিশ তদন্তে দেখেছে, ধর্ষণের শিকার নারীদের দুই–তৃতীয়াংশ শিশু। ধর্ষকদের সবচেয়ে বড় অংশ প্রতিবেশী। সাম্প্রতিক সময়ে সহপাঠী বা ফেসবুক বন্ধুদের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের মামলা হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৩-২০১৭ সালে ছয়টি মহানগর এলাকার মধ্যে ঢাকায় বিচারের হার ছিল সবচেয়ে কম। এই সময়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ মামলার বিচার হয়েছে ঢাকায়।

দেখা গেছে, নারী-শিশুদের বড় একটি অংশ বিচারের প্রাথমিক পর্যায় পেরোতেই হিমশিম খায়। ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের মধ্যে যারা থানায় গিয়ে হেনস্তার শিকার হয়, তাদের অর্ধেক বলেছে, পুলিশ মামলা রেকর্ড করলেও পাত্তা দেয়নি, মামলা দায়েরে নিরুৎসাহিত করেছে, ধর্ষণের শিকার হওয়ায় থানায় পুলিশ কটূক্তি করেছে কিংবা মামলা না করার জন্য থানায় বসেই হুমকি দিয়েছে। কেউ কেউ একের বেশি অভিযোগ করেছে।

গবেষণায় কামরাঙ্গীরচরে ধর্ষণের শিকার এক নারীর উদাহরণ এসেছে। বছর তিনেক আগে ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) ও পরে ওসিসির পরামর্শে তিনি থানায় যান। থানা তাঁকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, পরে তাঁকে একজন রাজনৈতিক নেতাকে সঙ্গে নিয়ে থানায় আসার নির্দেশ দেয় পুলিশ। বারবার অনুরোধের পর থানা মামলাটি নিতে রাজি হয়। একদিন পর তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে গেলেও কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ নেননি। আসামি ছয় মাস পালিয়ে ছিলেন। পুলিশ পলাতক অবস্থাতেও ধরার উদ্যোগ নেয়নি, পরেও নেয়নি বলে অভিযোগ করেন ধর্ষণের শিকার নারী।

থানায় হেনস্তার পাশাপাশি, মামলা দায়েরে ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশকে টাকা খরচ করতে হয়েছে। টাকার অঙ্ক ১ থেকে ১০০০ টাকা কিংবা তার চেয়ে বেশি। যদিও সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া নারী ও শিশুদের ৭২ দশমিক ৬ শতাংশের ধর্ষণের সময় কোনো আয়-রোজগার ছিল না।

ধর্ষণ মামলার তদন্ত করছেন কারা

ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশু বা তাদের পক্ষে কেউ মামলা দায়েরের পর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একজন তদন্ত কর্মকর্তাকে ঘটনাটি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেন। তিনি তদন্ত করে যে প্রতিবেদন জমা দেন, তার ওপরই নির্ভর করে ধর্ষণ মামলাটি এগোবে, নাকি থেমে যাবে। তদন্তকারী কর্মকর্তা নারী বা শিশুর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, প্রয়োজনীয় তথ্য ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করবেন, পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুকে সম্পৃক্ত রাখবেন, তাকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নেবেন, তার চিকিৎসা, পরামর্শ ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবেন। গবেষকেরা বলছেন, ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশু যেন সুবিচার পায়, তার ভিতটা গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব তদন্তকারী কর্মকর্তার।

গবেষণায় যেসব তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাঁরা ৭২ শতাংশ ক্ষেত্রে আসামি ধরতে পারেননি। ছয়টি মহানগর পুলিশ কর্তৃপক্ষের তিনটি—চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ, সিলেট মহানগর পুলিশ ও বরিশাল মহানগর পুলিশ একজন আসামিও ধরতে পারেনি। তদন্ত কর্মকর্তারা কোনো কোনো পক্ষ থেকে নেতিবাচক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ করেছেন।

তবে শুধু চাপের কারণে যে পুলিশ আসামি ধরে না, বিষয়টা তেমন নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের ৫৩ শতাংশ বলেছে, আসামি বরাবর পলাতক ছিল, ৭ দশমিক ২ শতাংশ ধর্ষক শক্তিশালী, ৫ দশমিক ২ শতাংশ পুলিশ ঘুষ খেয়েছে, ৪ দশমিক ১ শতাংশ পুলিশ গা করেনি এবং ১ শতাংশ বলেছে, পরোয়ানা জারি না হওয়ায় ও আপস হয়ে যাওয়ায় আসামি ধরা পড়েনি।

গবেষণা প্রতিবেদনে সুবিচার নিশ্চিত করতে আরও যেসব বাধার কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে নারী তদন্তকারী কর্মকর্তার অভাব, লেখাপড়া ও প্রশিক্ষণের অভাবের কথা বলা হয়েছে। তাঁরা মন্তব্য করেছেন, ধর্ষণের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে বিচার নিশ্চিত করতে বেশিসংখ্যক নারী তদন্তকারী কর্মকর্তা, উচ্চশিক্ষিত, বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রয়োজন।

কেন বেশিসংখ্যক নারী কর্মকর্তার প্রয়োজন, তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এভাবে, ‘বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় যৌন সম্পৃক্ততার মতো বিষয়গুলো অত্যন্ত সংবেদনশীল বলে ধরা হয়। প্রকাশ্যে কেন, ব্যক্তিগত আলাপেও এই আলোচনায় স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না অনেকে। এমন উদাহরণও কম নয় যেখানে ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশু সমাজে সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হয়। বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যে সে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তা–ও ধর্ষণের শিকার হওয়ার মতোই। বেশির ভাগই মানসিকভাবে খুব পর্যুদস্ত থাকে, যাদের বড় অংশ শিশু। তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের কষ্টের কথা বলতে পারে না। একজন নারী তদন্ত কর্মকর্তা এ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটাতে পারেন।’

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং জেন্ডারবিষয়ক প্রশিক্ষণের ঘাটতি কাটানো জরুরি বলে মন্তব্য করছেন গবেষকেরা। তাঁরা যে ৫৭৫টি মামলা খতিয়ে দেখেছেন, সেগুলোর ৪ শতাংশে নারী তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। তদন্ত কর্মকর্তাদের অর্ধেক উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করা এবং অর্ধেকের বেশি কনস্টেবল থেকে পদোন্নতি পেয়ে উপপরিদর্শক হয়েছেন। যে ১৯১ জন তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে মাত্র দুজনের জেন্ডার বিষয়ে সামান্য প্রশিক্ষণ ছিল। যদিও তদন্ত কর্মকর্তাদের ৯৭ দশমিক ৪ শতাংশই বলেছেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন এবং ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ বলেছেন, নারী কর্মকর্তারা ধর্ষণের বিষয়টা অনেক ভালোভাবে বুঝতে পারতেন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণায় ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশু যেন বিচার পায়, সে জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন হবে বলে তিনি আশা করেন।

নারী তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দিয়ে ধর্ষণের মতো মামলাগুলো তদন্তের একটা উদ্যোগ ঢাকায় আছে। উইমেন সা‌পোর্ট অ্যান্ড ইন‌ভে‌স্টি‌গেশন ডি‌ভিশ‌ন কাজটি করছে। রাতারাতি সব জায়গায় নারী কর্মকর্তা নিয়োগ সম্ভব না হলেও পর্যায়ক্রমে সব জায়গায় এই সেবা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক মো. সোহেল রানা।

বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইডের নির্বাহী পরিচালক ফারাহ কবির প্রথম আলোকে বলেন, এগুলো বহু পুরোনো সমস্যা। তারপরও পুলিশ সাধুবাদ পেতে পারে। কারণ, এত বছর পর হলেও তারা কোন কোন জায়গায় উন্নতির সুযোগ আছে, তা নিয়ে ভাবছে। এখন নাগরিক সমাজ ও অংশীজনদের নিয়ে তারা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয় কি না, সেটাই দেখার বিষয়।