প্রতিবাদ তো করে যেতেই হবে: অরুন্ধতী

অরুন্ধতী রায়। ছবি: তৌহিদা শিরোপা
অরুন্ধতী রায়। ছবি: তৌহিদা শিরোপা
>

ছবিমেলার আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছেন অরুন্ধতী রায়। খ্যাতিমান এই লেখক ও সাম্রাজ্যবাদের কঠোর সমালোচক মুখোমুখি হয়েছেন প্রথম আলোর।

‘আমি বরিশালে যেতে চাই। আমার বাবার বাড়ি বরিশাল। কতক্ষণ লাগে যেতে?’

অরুন্ধতী রায় খুবই আগ্রহভরে জানতে চাইলেন।

অরুন্ধতী রায়। বুকার পুরস্কারজয়ী ভারতীয় লেখক। দ্য গড অব স্মল থিংস–এর পাণ্ডুলিপি পড়ে তাঁর প্রকাশক তাঁকে অগ্রিম দিয়েছিলেন পাঁচ লাখ পাউন্ড। তারপর সবই ইতিহাস।

অরুন্ধতী রায় ৩ মার্চ ২০১৯ এসেছেন ঢাকায়। ৪ মার্চ সকাল সকাল আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হাজির ধানমন্ডির এক বাড়িতে। দিনটা ছিল মেঘে ঢাকা। অরুন্ধতীকে মনে করিয়ে দিলাম, আপনার দ্য গড অব স্মল থিংস–এর শুরুর বর্ণনার মতো সোমবার ঢাকার দিনটা ভেজা আর শেওলাময়।

যে অরুন্ধতী রায় স্বাধীনভাবে কথা বলে এক দিনের জন্য জেল খেটেছেন, কিন্তু মাথা নত করেননি; যিনি আমেরিকার যুদ্ধনীতি, ভারতের কাশ্মীর-দলিত-গোরক্ষা-আদিবাসী সব জ্বলন্ত ইস্যুতে সবচেয়ে প্রজ্বলন্ত কণ্ঠস্বর, তাঁর সঙ্গে আলাপটা কেমন জমবে, একটা দুর্ভাবনা ছিল। কিন্তু মুখে মিষ্টি হাসি, চোখে বুদ্ধির ঝিলিক, কণ্ঠস্বরে আন্তরিকতার মাধুর্য, এক নিমেষেই অরুন্ধতী আমাকে আর সহকর্মী তৌহিদা শিরোপাকে আপন করে নিলেন।

অরুন্ধতী ঢাকায় এসেছেন ছবিমেলার আমন্ত্রণে। আজ মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে তিনি কথাও বলবেন নিবন্ধিত দর্শকদের সামনে। আলোকচিত্রী শহিদুল আলম অরুন্ধতীর দিল্লির বাড়িতে গিয়ে তাঁকে ঢাকা আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিলেন। তারপর অল্প দিনের মধ্যেই শহিদুল আলমকে কারাগারে নেওয়া হয়। অরুন্ধতী তাঁর মুক্তি চেয়ে তাঁকেই একটা খোলা চিঠি লেখেন। তাতে তিনি বলেন, ‘আসলে এই চিঠি আমি শুধু তোমাকে লিখছি না, লিখছি আরও প্রিয়জনকে, সুধা, সুরেন্দ্র, রাজু এমনি অনেককে, কারণ শয়ে শয়ে এমন নামের মানুষ কারান্তরালে।’ ওই চিঠির শেষে অরুন্ধতী লিখেছিলেন শহিদুল আলমকে, ‘শিগগিরই ঢাকায় তোমার সঙ্গে দেখা হবে।’

অরুন্ধতী যেতে চান বরিশালে। তাঁর বাবার গ্রামের নাম তিনি মনে করতে পারেন লাকোতিয়া। গুগল করে বুঝলাম, লাকুটিয়া। বরিশাল থেকে আট কিলোমিটার দূরে। তাঁর বাবা রাজীব রায়, মেঘালয়ের শিলংয়ে চা-বাগানের ম্যানেজার ছিলেন। আর মা ছিলেন সিরিয়ান বংশোদ্ভূত মালয়ালি খ্রিষ্টান। অরুন্ধতীর বয়স যখন দুই, তখন থেকেই বাবা–মা আলাদা হয়ে যান। শিশু অরুন্ধতী আর তার বড় ভাইকে নিয়ে মা ফিরে যান কেরালায়। নিজে একটা স্কুল চালাতেন মা। বাবার সঙ্গে এরপর বহু বছর অরুন্ধতীর দেখা হয়নি। যে বাবার সঙ্গে বহু বছর দেখাও হয় না, সেই বাবার আদিবাড়ির খোঁজে বরিশাল যেতে খুব সাধ হয় অরুন্ধতীর।

অরুন্ধতী ১৬ বছর বয়সে দিল্লি আসেন। স্থাপত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। রুমমেট ছিল উড়িষ্যার। তার সঙ্গে কথা হতো ছবি এঁকে এঁকে। কারণ কেউ কারো ভাষা বোঝেন না। তারপর তিনি সিনেমা করেছেন, সিনেমার পরিচালককে বিয়ে করেছিলেন। স্থপতির জীবন নিয়ে যে সিনেমা তারা করেছিলেন, তা জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিল। বহু বছর পর ভারতে বুদ্ধিজীবীদের ওপরে আক্রমণ হতে শুরু করলে প্রতিবাদে সেই জাতীয় পুরস্কার বর্জনও করেছিলেন সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার জেতা অরুন্ধতী।

অরুন্ধতীকে বলি, ‘আপনি দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস শেষ করেছেন, একটা গুবরে পোকার গল্প দিয়ে, ওই পোকাটা গোবরে চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে পা তুলে ধরে থাকে। যদি আকাশ ভেঙে পড়ে, সে তার পা দিয়ে ঠেকাবে। এখন পাকিস্তানে ইমরান, ভারতে গুজরাত কি লালা, আমেরিকায় ট্রাম্প। নিজেকে তো গুবরে পোকার চেয়েও অসহায় লাগে। আমরা তো কিছুই ঠেকাতে পারব না।’

অরুন্ধতী হার মানতে চান না। তিনি বলেন, ‘না, তবু পোকা পা তুলে ধরেই থাকবে। ওদের কাজ ওরা করে যাচ্ছে। আমাদের কাজ আমরা করে যাব। আমাদের প্রতিবাদ করে যেতে হবে। পৃথিবী বদলাবে। তাকে বদলাতেই হবে।’

তাঁকে বলি, ‘মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস–এর মতো তীব্র আগুনে তাতানো বই লেখার পরেও আপনি দেশে থাকতে পারছেন। এটা তো ভালো ব্যাপার।’

তিনি বলেন, ‘আপনাকে জানতে হবে কখন আপনি এগোবেন, কখন পেছাবেন। কখন সরে যাবেন। আগুন নিয়ে কাজ করলে আগুনের আঁচ তো লাগবেই। তবে আমাদের রক্ষা করে ক্ষমতাবানদের উদারতা নয়। আমাদের রক্ষা করে আমাদের কাজ। আমাদের শিল্প। শহিদুলের কাজ। শহিদুলের আলোকচিত্র। এসবই আমাদের রক্ষাকবচ দেয়।’

তিনি পুঁজিবাদ, প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন, করপোরেটের নামে মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়ার ঘোর বিরোধী। ৯ জন ভারতীয়র কাছে যা সম্পদ আছে, তার পরিমাণ ৫০ কোটি ভারতীয়র সম্পদের সমান। এটা তিনি মানতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের ন্যূনতম চাওয়া হলো মানসম্পন্ন জীবনযাপনের উপযুক্ত মজুরি, সবার শিক্ষার অধিকার, সবার খাদ্যের অধিকার আছে—এই রকম একটা কল্যাণ রাষ্ট্র।’

‘ভারত-পাকিস্তান রণডঙ্কা নিয়ে কিছু কি বলবেন?’ তিনি বলেন, ‘আমি হাফিংটন পোস্ট–এ লিখেছি। আর কিছু বলতে চাই না।’

ওই রচনায় তিনি বলেছেন, ‘যখন পুলওয়ামাতে হামলা হলো, এটা মোদির জন্য সুবর্ণ সুযোগ এনে দিল; কারণ সামনে নির্বাচন। এই সুযোগটা মোদি কাজে লাগাবেন। নির্বাচনে তিনি হারছিলেন। আমরা এই ধরনের একটা ঘটনা ঘটার আশঙ্কা করছিলাম। সেটাই সত্য হচ্ছে।’

অরুন্ধতীকে বলি, ‘অরুন্ধতী, আমরা প্রতিবাদ করতে পারি, কিন্তু প্রতিরোধ করতে পারব না। এই লড়াইয়ে আমাদের বিজয় আসবে না।’

অরুন্ধতী তা মানতে নারাজ। যদিও তিনি অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে চান না। তিনি মনে করেন, তিনি লেখক, লেখাই তাঁর কাজ। এবং আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নিজের কাজের ভেতর দিয়ে যদি প্রতিবাদ করতে থাকি, মানুষের জয় হবেই। অরুন্ধতী তা মনে করেন।

আর মনে করেন, সব সময় একটা প্রতিবাদী ভাবমূর্তি ধরে রাখার চেষ্টা করারও দরকার নেই। সংগীত, শরীরচর্চা, শিল্প, খাদ্য—সবকিছুই তো একটা মানুষের জীবনে থাকবে। সেসব নিয়ে তিনি যা বলেছেন, তৌহিদা শিরোপার কলমে তা প্রকাশিত হবে আগামীকালের অধুনায়। আর তাঁর দুই উপন্যাসের গঠনশৈলী ইত্যাদি নিয়ে যা কথা হয়েছে, তার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করা হবে ভবিষ্যতে অন্য আলোর পাতায়।

অরুন্ধতী যেতে চান বরিশালের লাকুটিয়া গ্রামে। বরিশাল থেকে আট কিলোমিটার দূরে। গ্রামটা সুন্দর, পুরোনো জমিদার বাড়ি আছে। আমারও যেতে ইচ্ছা করে। অরুন্ধতী যদি যান, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন, সেই কথা পাকা করে আমরা বিদায় নিই। তাঁর মধুর সাহচর্যের আবেশ আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে বহুক্ষণ।