শব্দেই জব্দ হচ্ছে নারী

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে ‘শব্দে জব্দ নারী’ শীর্ষক প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন অতিথিরা। ঢাকা, ৬ মার্চ। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে ‘শব্দে জব্দ নারী’ শীর্ষক প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন অতিথিরা। ঢাকা, ৬ মার্চ। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

‘কুড়িতেই বুড়ি’ কথাটার প্রচলন বহুল হলেও ‘বুড়ো’ শব্দটি এ কথাটায় কেউ যুক্ত করে না। ‘মাইয়্যা মানুষ মাইয়্যা মানুষের মতো থাকো’— নারীর জীবনে যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত এ বাক্যটি। আর কোনো ঝগড়া বিবাদ বা মারামারিতে নারী ও তার শরীরই মৌখিক সহিংসতার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে মা ও বোনকে নিয়ে বাজে শব্দই ব্যবহৃত হয়। সমাজে নারীর প্রতি নেতিবাচক এসব শব্দ ও বাক্য তুলে ধরে এসব জায়গায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য আহ্বান জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ।

আজ বুধবার রাজধানীতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে ‘শব্দে জব্দ নারী’ শীর্ষক প্রদর্শনী ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ছিল এই আয়োজন। মিলনায়তনের দেয়ালগুলোয় নানান ধরনের উক্তি এবং শব্দ বাক্যের মাধ্যমে তুলে ধরে দেখানো হয়েছে সমাজে নারীকে শব্দ দিয়ে কতভাবে জব্দ করা হচ্ছে।

‘বিয়ের পরে জামাই নিয়ে যত খুশি ঘুরতে যেও’, ‘বুড়ির সাজ দেখছ?’ ‘একা কোথাও যেও না’—এ রকম নিষেধাজ্ঞা ও অপমানজনক তির্যক মন্তব্যকে সঙ্গী করেই নারীদের চলতে হচ্ছে। এক অংশের দেয়ালের সাঁটানো ফেসবুকের নানান মন্তব্য। ফেসবুক হাতের নাগালে হওয়ায় নারী যে কতভাবে হেনস্তা হতে পারে, তার কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এখানে।

প্রদর্শনীর বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখছেন অতিথিরা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা, ৬ মার্চ। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
প্রদর্শনীর বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখছেন অতিথিরা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা, ৬ মার্চ। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

পাঠ্যবইয়েও নারী শব্দের মাধ্যমে জব্দ হচ্ছে। সেটাও তুলে ধরা হয়েছে এ প্রদর্শনীতে। গায়ের রং কেমন হলে কোন পোশাক পরা উচিত বা উচিত নয়, দেখতে কেমন লাগবে, সেসব অন্তর্ভুক্ত হয়েছে পাঠ্যবইয়ে। এসবেরও সমালোচনা করেন এই আয়োজনে আসা অতিথিরা।

অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ জানায়, তাদের ‘সেইফ সিটিজেন ফর উইমেন’ নামের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৮৮ শতাংশ নারী রাস্তায় অপমানজনক মন্তব্যের মুখে পড়েন এবং ৪৬ শতাংশ নারী অপমানজনক ভাষার শিকার হন। এদের মধ্যে ৮৬ শতাংশ নারী চালক ও চালকের সহকারী দ্বারা এবং ৬৯ শতাংশ দোকানদার ও বিক্রেতাদের মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের শিকার হন।

অ্যাকশনএইডের নির্বাহী পরিচালক ফারাহ কবির আলোচনা সভায় সঞ্চালকের ভূমিকায় বলেন, ‘শব্দ, বাক্য, উক্তিতে লিঙ্গ থাকার কথা না। কিন্তু অনেক সময় দেখি আমাকে কেউ পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে মেয়ে মানুষ। মানুষ বললে কী সমস্যা ছিল?’ তিনি বলেন, সামাজিক কাঠামোতে পড়ে নারীরাও নারীদের দিকে এসব শব্দ ছুড়ে দিচ্ছেন।

প্রদর্শনীর পাশাপাশি আলোচনা সভারও আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা, ৬ মার্চ। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
প্রদর্শনীর পাশাপাশি আলোচনা সভারও আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা, ৬ মার্চ। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

নারীদের সবকিছুতেই নিজেকে উত্তম প্রমাণ করতে হয় বলে জানান নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির। তিনি বলেন, নারীত্ব দুর্বলতা না। শব্দকে লিঙ্গায়ন করা হয়। শব্দকে তৈরি করা হয় নারীর জন্য। শব্দের মধ্যে লিঙ্গ ব্যবহার না করার আহ্বান জানান তিনি। 
দৈনিক ইত্তেফাক-এর সম্পাদক তাসমিমা হোসেন বলেন, তিনি নিজেও শব্দে অনেকবার জব্দ হয়েছেন।

‘সতী’ বা ‘পতিতা’ শব্দের কোনো পুরুষতান্ত্রিক শব্দ নেই। আবার সন্তানের ভালো-মন্দে ‘ভালো মা’ বা ‘বাজে গর্ভ’ খেতাব দেওয়া হয়। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা ইসলাম। তিনি বলেন, পুরুষকে সিংহ বা বাঘের সঙ্গে তুলনা করা হয়। নারীকে তুলনা করা হয় সাপের সঙ্গে। সালমা ইসলাম বলেন, ‘মেয়েরা সাহসী হবে, তা আমাদের অভিধানে নাই। শব্দ মেয়ে-ছেলে না, এটা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা।’ নাটক, সিনেমা, উপন্যাস বা সাহিত্যেও নারীর চরিত্রে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতাতেই তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া বলেন, ‘ভাতার’ শব্দটিতে অর্থনৈতিক নির্ভরতা বোঝায়। অর্থাৎ ভাত যিনি দেন। নারীকে এখনো সম্পদের বাইরে দেখা হয় না।

প্রদর্শনী ঘুরে দেখছেন দর্শনার্থীরা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা, ৬ মার্চ। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
প্রদর্শনী ঘুরে দেখছেন দর্শনার্থীরা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা, ৬ মার্চ। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

নিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান বার্তা সম্পাদক শাহনাজ মুন্নী বলেন, গণমাধ্যমে স্বামী পরিত্যক্তা বা তালাকপ্রাপ্ত শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়। কিন্তু স্ত্রী পরিত্যক্তা কাউকে বলা হয় না। তিনি বলেন, আগের চেয়ে শব্দ চয়নে গণমাধ্যমে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তবে এখনো অনলাইন মাধ্যমগুলোয় অপমানজনক শব্দ দেখা যায়।

আলোচনা সভা থেকে সমাজকে আরও লিঙ্গ সংবেদনশীল করে তুলতে ইতিবাচক শব্দ ব্যবহারে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এখানে আরও বক্তব্য দেন চলচ্চিত্র পরিচালক শামীম আক্তার, অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের নির্বাহী সদস্য খলিলুর রহমান প্রমুখ।