রায়পুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫০ শয্যার বিপরীতে চিকিৎসক ৭

নরসিংদীর রায়পুরার জাহাঙ্গীরনগরের আরতি রানী বিশ্বাসের চিকিৎসা চলছে একটি হাসপাতালে। জরুরি প্রয়োজনে গতকাল বুধবার দুপুর ১২টায় ছেলে উত্তম বিশ্বাসের সঙ্গে রায়পুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান শরীরে এক ব্যাগ রক্ত সঞ্চালন করতে। রক্তদাতাও হাজির। কিন্তু এই হাসপাতালে রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা না থাকায় তাঁকে ফিরে যেতে হয়। ভারাক্রান্ত মনে তিনি শহরের কোনো হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হন।
উত্তম বিশ্বাস বলেন, একজনের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে আরেকজনকে দেওয়ার সামান্য সুবিধাটুকু এই হাসপাতালে নেই। এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী হতে পারে?

প্রশাসনিকভাবে দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা হলেও নরসিংদীর রায়পুরার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারছে না। ২৪টি ইউনিয়নের ৬ লাখ মানুষের দৈনন্দিন স্বাস্থ্যসেবা নির্ভর করে হাসপাতালটির ওপর। ৫০ শয্যার এই হাসপাতালে চিকিৎসক আছেন মাত্র সাতজন। জনবলের অভাবে কোনো রকমে চলছে হাসপাতালটি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সীমিত সামর্থ্য দিয়েই সেবা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

জানা গেছে, রায়পুরা উপজেলার জনসংখ্যা ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৭৯৬। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির আওতায় ২৪টি ইউনিয়নে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও অবকাঠামো আছে মাত্র দুটির। ১৯৮০ সাল থেকে ৩১ শয্যার হাসপাতাল হিসেবে রায়পুরাবাসীকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছে হাসপাতালটি। ২০১২ সালের ৩০ নভেম্বর হাসপাতালটিকে ৫০ শয্যায় উন্নীতকরণের কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন স্থানীয় সাংসদ এবং তৎকালীন শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী রাজিউদ্দীন আহমেদ। সাত বছর আগে ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও বর্তমানে জনবল আছে ৩১ শয্যার কাঠামোতেই।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ৫০ শয্যার এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আওতায় মোট চিকিৎসক থাকার কথা ৩৫ জন। তবে পদ আছে ২৯ জনের। এর মধ্যে ১৪ জন আছেন প্রেষণে। বেতন তোলেন এখান থেকে, কিন্তু জেলার অন্যান্য হাসপাতালে দায়িত্বে আছেন এমন চিকিৎসক আছেন কয়েকজন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা, তিনজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট ও দুজন চিকিৎসা কর্মকর্তা আছেন হাসপাতালটিতে। আরও আছেন একজন করে দন্ত ও ইউনানি চিকিৎসক। উপসহকারী চিকিৎসা কর্মকর্তা আছেন ১০ জন। আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ইসমাইল আল রাজীব জরুরি ও বহির্বিভাগে রোগী দেখেন। এখানে চিকিৎসা নিতে আসা বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগের সব রোগীকেই ওষুধ দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালটিতে প্রতিদিন গড়ে বহির্বিভাগে ৩০০ জন ও জরুরি বিভাগে ১০০ জন রোগী যান। শ্বাসকষ্ট ও মারামারির রোগীরা বেশি আসেন এই হাসপাতালে। টেঁটাযুদ্ধ খ্যাত রায়পুরার এই হাসপাতালে টেঁটাবিদ্ধদের সেবা দেওয়ার সুযোগ নেই। হাসপাতালে দরকার চক্ষু, চর্ম, অর্থোপেডিকস ও নাক কান গলার চিকিৎসক। চিকিৎসক দরকার সার্জারির। একজন সুইপার, দুজন ওয়ার্ডবয় ও মাত্র একজন আয়া আছেন এখানে। কিন্তু কোনো ইলেকট্রিশিয়ান নেই। নার্স আছেন ২০ জন। পেট্রলে খরচ বেশি লাগে বলে জেনারেটরটি চালু করা হয় না। গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রোপচারের সময় শুধু ওটির জন্য চালু করা হয় এটি। এক্স-রে, ইসিজি ও আলট্রাসনোগ্রাফি যন্ত্র ভালো আছে। তবে রেডিওলজিস্ট ও সনোলজিস্ট নেই। দুজন টেকনিশিয়ান এগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন প্যাথলজি পরীক্ষা করেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ৩১ জন রোগী ভর্তির সুযোগ আছে হাসপাতালটিতে। গতকাল বেলা ৩টা পর্যন্ত ভর্তি ছিলেন ২৬ জন। তাঁদের মধ্যে নারী ১৭ জন। সেখানে দেখা যায়, বাচ্চু মিয়া নামের একজন মাদ্রাসা শিক্ষক ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চার দিন আগে এখানে ভর্তি হয়েছি। দুই দিন পরে জ্ঞান আসার পর থেকে দুর্বলতার কারণে কিছুই খেতে পারছি না। এত করে বললাম, একটা স্যালাইন দিতে। দিচ্ছে না।’ এরপর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তিনি হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান।

আরেকজন রোগী চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও হাসপাতাল থেকে দেওয়া ওষুধ দেখিয়ে বললেন, ব্যথা ও গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ছাড়া কিছুই দেওয়া হয়নি। বাকি ওষুধগুলো বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনতে হয়েছে।
জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, মো. ফরিদ হোসেন ও বিপ্লব কুমার সাহা নামের দুজন উপসহকারী চিকিৎসা কর্মকর্তা রোগী দেখছেন। তাঁদের হাত থেকে ব্যবস্থাপত্র টানাটানি করছিলেন নাজমুল হক নামের একজন। পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মেডিকেল অফিসার প্রকাশ চন্দ্র সরকারের সঙ্গে এসেছি।’ বলতে বলতে তিনি জরুরি বিভাগ ত্যাগ করেন। হাসপাতালে ২ ঘণ্টা অবস্থান করেও জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রকাশ চন্দ্র সরকারকে দেখা যায়নি।

স্থানীয় অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, হাসপাতালটি চলছে মূলত উপসহকারী চিকিৎসা কর্মকর্তাদের দিয়ে। বেলা আড়াইটা পর্যন্ত বহির্বিভাগ খোলা থাকার নিয়ম থাকলেও দুপুর ১২টার দিকেই সবাই আস্তে আস্তে চলে যায়। এমনকি টিকিট কাউন্টারেও লোক থাকে না। অন্তত যে চিকিৎসকেরা আছেন, তাঁরা যদি সময়মতো উপস্থিত থাকতেন, তবে কিছুটা চলত। একটি অ্যাম্বুলেন্স আছে, কিন্তু চালকের বাড়ি দূরে হওয়ায় এর সেবা ঠিকমতো পাওয়া যায় না। হাসপাতালটিতে ২-৩ জন নারী ও ৩-৪ জন পুরুষ দালাল আছে। জরুরি বিভাগে টাকা ছাড়া কোনো সেবা পাওয়া যায় না। সেখানে ড্রেসিং করতে গেলে ১০০ টাকা, সেলাই করলে ২০০ টাকা আর ইনজেকশন দিতে গেলে ৫০ টাকা করে দিতে হয়। সকাল বা রাতে প্রসূতি রোগী এলে তাঁদের পার্শ্ববর্তী বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবু সাইদ মোহাম্মদ ফারুক বলেন, ‘জরুরি বিভাগে অন্তত আরও তিনজন চিকিৎসক জরুরি ভিত্তিতে দরকার। ৫০ শয্যার জনবল যখন আমরা পাব, তখন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তবে সেবা নিতে আসা কোনো রোগীকে আমরা ফিরিয়ে দিই না।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চিকিৎসকদের প্রেষণে থাকা ও সংযুক্তির মতো বিভিন্ন কারণে হাসপাতালটির এমন অবস্থা। তা ছাড়া দালাল ও অন্যান্য সমস্যার বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ পেয়ে আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত করেছি। যদি এখনো দালালেরা থেকে থাকে, তবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’