দোতলা থেকেই আগুনের শুরু

>

• ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে
• ঘটনাস্থলে ৬৭ জন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ জনের মৃত্যু
• বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা
• সাত পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে সাত দফা সুপারিশ রয়েছে
• দাহ্য পদার্থের ছোট মজুতাগার কারখানা দ্রুত সরাতে হবে
• আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়াতে হবে

পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাতের কোনো আলামত পায়নি বিস্ফোরক পরিদপ্তর। ওই মোড়ে অবস্থিত ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলা থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। ওই তলায় রাখা সুগন্ধির ক্যানগুলো থেকে কোনো কারণে রাসায়নিক মিশ্রণ বের হয়ে বাতাসে ‘বিস্ফোরক মিশ্রণ’ তৈরি হয়েছিল। ‘জিপার লক মেশিনে’ কাজের সময় সৃষ্ট তাপ বা কোনো কারণে বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ ওই মিশ্রণের সংস্পর্শে এসে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।

চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কারণ উদ্‌ঘাটনে আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিস্ফোরক পরিদপ্তর।

দুর্ঘটনার ১৩ দিন পর গতকাল বুধবার এই তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। সাত পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে আবাসিক ভবন থেকে দাহ্য, অদাহ্য, বিষাক্ত এবং স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক যেকোনো ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যের মজুতাগার, কারখানা অপসারণসহ সাত দফা সুপারিশ রয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. সামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য, ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং অনুসন্ধান শেষে তাঁরা এই তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের বৈজ্ঞানিক কারণ তুলে ধরা হয়েছে। আগুনের সূত্রপাত যে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে হয়নি, তা তাঁরা প্রমাণ করতে পেরেছেন। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল বলেও নিশ্চিত হয়েছেন।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ঘটনাস্থলেই ৬৭ জন মারা যান। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় দগ্ধ আরও চারজনের। ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন আলাদা আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ওয়াহেদ ম্যানশন ছাড়া পার্শ্ববর্তী ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন গতকাল ভারপ্রাপ্ত শিল্পসচিব মোহাম্মদ আবদুল হালিমের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এই তদন্তের ফলাফল সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন ২ মার্চ তাদের প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেয়। সিলিন্ডার থেকে নয়, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার রাসায়নিকের গুদাম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে প্রতিবেদনে তারা উল্লেখ করে। সূত্র জানিয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত প্রতিবেদনও শেষ পর্যায়ে।

বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পারফিউম, বডি স্প্রে বা এয়ার ফ্রেশনারের ক্যানে অন্যান্য পদার্থ ছাড়াও সুগন্ধি বিউটেন, আইসো বিউটেন, আইসো প্রোপাইল অ্যালকোহল, রেকটিফাইড স্পিরিট বিভিন্ন অনুপাতে মেশানো থাকে। বাতাসে এগুলোর অনুপাত ন্যূনতম ১ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে হলেই বিস্ফোরণ মিশ্রণ তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ওয়াহেদ ম্যানশনে বসবাসকারী বাসিন্দা ও এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, দোতলার কক্ষ থেকে তীব্র সুগন্ধির গন্ধ পাওয়া যেত এবং সেখানে ক্যানে গ্যাস ফিলিং করা হতো। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গ্যাস ফিলিংয়ের কোনো যন্ত্র পাওয়া না গেলেও ‘জিপার লকার মেশিন’ পাওয়া যায়। এর সাহায্যে তাপ প্রয়োগে প্লাস্টিকের প্যাকেটের মুখে সিল করা হয়ে থাকে। দোতলার কক্ষে তাই প্যাকেট সিল করার কাজ করা হতো।

প্রতিবেদনে আগুন ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ওয়াহিদ ম্যানশনের নিচতলায় প্লাস্টিকের দানার গুদামে অসংখ্য প্লাস্টিকের দানা (পলিইথিলিন) এবং তার বিপরীত দিকের ভবনের নিচতলায় রাসায়নিক দ্রব্যসহ প্লাস্টিকের দানার গুদাম ছিল। প্লাস্টিকের দানা প্রথমে গলে যায় এবং আগুনে প্রজ্বলিত হয়ে অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। পলিইথিলিনের দহন তাপ বেশি হওয়ায় আগুনের তীব্রতা ও শিখা ছড়িয়ে পড়ার গতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। আগুনে পলিইথিলিন দানা গলে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই–অক্সাইড, হাইড্রোজেন সায়ানাইড ইত্যাদি বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। এর ফলে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের সময় চুড়িহাট্টা মোড়সহ ওয়াহিদ ম্যানশনের নিচতলার প্যাসেজ ও অন্যান্য ভবনের নিচে বহু ব্যক্তি বিষক্রিয়ায়, অক্সিজেন স্বল্পতায় এবং শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়াসহ প্রচণ্ড আগুনের তাপে দগ্ধ হয়ে মারা যান।

সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত না হওয়ার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুড়িহাট্টা জামে মসজিদের সামনে বিপরীতমুখী দুটি কারের একটির সিএনজি সিলিন্ডার অক্ষত ছিল। অন্য কার ও পিকআপে কোনো সিলিন্ডার ছিল না। পিকআপ ভ্যান ও কারের ভেতরের ইঞ্জিন ফুয়েল লাইনসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ পুড়ে ভস্মীভূত হলেও ওপরের কাঠামোর তেমন ক্ষতি হয়নি। পিকআপ ভ্যানের পেছনে কথিত এলপিজি সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হলে ওই গাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হতো। তা ছাড়া সিলিন্ডারের বিভিন্ন অংশ ওই রাস্তার মোড় ছাড়াও চার শ থেকে পাঁচ শ ফুট দূরত্বে আঘাত করত। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের পর দূরবর্তী কোনো ভবনে আঘাতের আলামত বা সিলিন্ডারের অংশবিশেষও পাওয়া যায়নি।

সাত দফা সুপারিশ
তদন্ত প্রতিবেদনে সাতটি সুপারিশ তুলে ধরেছে বিস্ফোরক অধিদপ্তর। বলা হয়েছে, পুরান ঢাকা এলাকায় দাহ্য ও অতি দাহ্য পদার্থের ছোট ছোট মজুতাগার, কারখানা দ্রুত নিরাপদ কোনো স্থানে সরাতে হবে। অননুমোদিত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারকারী কারখানাগুলোতে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়াতে হবে এবং আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। সব ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যের মজুতাগার ও কারখানায় রাসায়নিক দ্রব্যের নাম ও তালিকা সংরক্ষণ প্যাকেজে সতর্কীকরণ চিহ্ন, ম্যাটেরিয়াল সেফটি ডেটা শিট সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।