ডাকসু নির্বাচনে আচরণবিধির তোয়াক্কা করছে না কেউই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন নিয়ে চলতি বছরের শুরুতে আলোচনা শুরু হয়৷ ১০ জানুয়ারি ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধনের বিষয়ে মতামত নিতে ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেই সভায় গঠনতন্ত্রের বিষয়ে মৌখিকভাবে দলীয় প্রস্তাবনা উপস্থাপন করে ছাত্রসংগঠনগুলো। তাদের দাবি অনুযায়ীই প্রণীত হয় আচরণবিধি। তবে সেই আচরণবিধির তোয়াক্কা করছে না কোনো ছাত্রসংগঠনই।

ডাকসু নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হয়েছে গত ৩ মার্চ থেকে। এখন পর্যন্ত আচরণবিধি লঙ্ঘনের অন্তত ৯টি ঘটনা ঘটেছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ বেশি রয়েছে ছাত্রলীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রদলও আচরণবিধি লঙ্ঘনে পিছিয়ে নেই। আচরণবিধি ভাঙছে বামপন্থী জোট ও সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদও।

সুফিয়া কামাল হলে রাত ১১টার পরেও মাইক ব্যবহার ছাত্রলীগের

নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ৭ মার্চ বৃহস্পতিবার রাত ১১টার পরেও মাইক ব্যবহার করে কবি সুফিয়া কামাল হল সংসদে নিজেদের দলীয় প্যানেলের পরিচিতিসভা করেছে ছাত্রলীগ। বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ২০ মিনিটে শুরু হয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে এই সভা চলে।

ডাকসু নির্বাচনের আচরণবিধির ৫(জ) ধারায় বলা হয়েছে, শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় সভা, সমাবেশ ও অডিটোরিয়ামে মাইক ব্যবহার করা যাবে। তবে কোনোক্রমেই রাত ১১টার পরে মাইক ব্যবহার করা যাবে না। আর ৪(খ) ধারায় বলা হয়েছে, প্রতিদিন প্রচারণার সময় সকাল ১০টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে।

পরিচিতিসভায় সুফিয়া কামাল হল সংসদে ছাত্রলীগের প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী ইসরাত জাহান ইভা, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী শাহরিয়ার সুলতানা নদী ও অন্য প্রার্থীরাসহ ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদে সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী গোলাম রাব্বানী ও সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) প্রার্থী সাদ্দাম হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

জানতে চাইলে সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগ প্যানেলের জিএস প্রার্থী শাহরিয়ার সুলতানা নদী প্রথম আলোর কাছে ১১টার পরেও তাঁদের প্রচারণায় মাইক ব্যবহারের বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি জানি যে রাত ১২টা পর্যন্ত প্রচারণা ও মাইকের ব্যবহার দুটোই করা যাবে।’

সভায় অংশ নেওয়া ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদে এজিএস প্রার্থী সাদ্দাম হোসেন বলেন, ১১টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত তাঁরা সুফিয়া কামাল হলে ছিলেন। ১২টার আগে সাউন্ড সিস্টেম বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে সুফিয়া কামাল হলের রিটার্নিং কর্মকর্তা মোসা. রেবেকা সুলতনাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। আর হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিতা রিজওয়ানা রহমানকে ফোন করলে প্রশ্ন শোনার পর তিনি ফোন কেটে দেন। পরে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি আর ফোন ধরেননি।

আবারও আচরণবিধি ভাঙল ছাত্রদল

ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের আচরণবিধি ভঙ্গ করে ডাকসুর ভোটার বা প্রার্থী নন, এমন নেতা-কর্মীদের নিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। এর আগে গত মঙ্গলবার আচরণবিধি ভঙ্গ করে অছাত্রদের নিয়ে ডাকসুতে নিজেদের দলীয় প্যানেলের পক্ষে ক্যাম্পাসে প্রচারণা চালায় ছাত্রদল।

ডাকসু নির্বাচনের আচরণবিধির ৪(গ) বলা হয়েছে, ‘ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোটার বা প্রার্থী ছাড়া অন্য কেউ কোনোভাবেই কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রচারণা চালাতে পারবেন না।’

বৃহস্পতিবার দুপুরে মধুর ক্যানটিন থেকে মিছিল বের করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। মিছিলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার ও সাধারণ সম্পাদক আবুল বাসার সিদ্দিকী, ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদে ছাত্রদল থেকে সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী আনিসুর রহমান খন্দকারসহ সংগঠনটির শতাধিক নেতা-কর্মী অংশ নেন৷ ছাত্রত্ব না থাকা ও বয়স ৩০-এর বেশি হওয়ায় ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার দুই শীর্ষ নেতা ডাকসু নির্বাচনের ভোটার বা প্রার্থী কোনোটিই নন।

মধুর ক্যানটিন থেকে মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রদক্ষিণ করে রেজিস্ট্রার ভবন এলাকা ঘুরে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা৷ মিছিলে দুর্নীতির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে স্লোগান দেন তাঁরা৷

সমাবেশে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট চেয়ে বক্তব্য দেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান। বয়স ৩০-এর বেশি হওয়ায় এই দুই নেতার কেউই ডাকসুর ভোটার বা প্রার্থী নন৷

সমাবেশে রাজিব আহসান বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের বিবেকের জাগ্রত রায় মোস্তাফিজ-অনিক-সোহেল প্যানেলের পক্ষে দেবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর অধিকার নিশ্চিত করবেন৷ দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নেতৃত্ব দেবে ডাকসু।’

আকরামুল হাসান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সে জন্য ছাত্রদলের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। আগামী ১১ মার্চের ডাকসু নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের রায়ের মাধ্যমে ছাত্রদলকে বিজয়ী করবে বলে প্রত্যাশা করছি৷’

আচরণবিধি লঙ্ঘন করে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিব আহসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা প্রচারণা করিনি। সব সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কিন্তু ভোটার নন। তাই বলে কি তারা ক্যাম্পাসে আসেন না? আমরা আমাদের প্যানেলের সঙ্গে ক্যাম্পাসে এসেছি। প্রচারণায় অংশ নিচ্ছি না, লিফলেট বিতরণ করছি না।’

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক গতকাল বিকেলে দাবি করেন, আচরণবিধি মেনেই তাঁরা প্রচারণা চালাচ্ছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, প্রমাণসহ অভিযোগ এলে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন।

আচরণবিধি লঙ্ঘনের যত ঘটনা

গত বুধবার দুপুরে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদে নিজেদের দলীয় প্যানেলের পরিচিতিসভা করে ছাত্রলীগ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মঞ্চ স্থাপন করে এ সভা করা হয়৷ কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের আচরণবিধির ৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী বা তাঁর পক্ষে কোনো ছাত্রসংগঠন, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী গেইট, তোরণ, ঘের নির্মাণ, প্যান্ডেল, ক্যাম্প, শামিয়ানা, মঞ্চ স্থাপন ও আলোকসজ্জা করতে পারবেন না। এ ছাড়াও, এই সভায় ডাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্যানেলে অংশ নেওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে উস্কানিমূলক ও মানহানিকর বক্তব্য দেন ছাত্রলীগ প্যানেলের এক প্রার্থী, ডাকসুর আচরণবিধির ৯(ক) অনুযায়ী যা নিষেধ।

তবে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর সহসাধারণ সম্পাদক(এজিএস) পদপ্রার্থী সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁরা কোনো মঞ্চ স্থাপন করেননি। তিনি বলেন, ‘এটি মঞ্চ ছিল না। এটি ছিল একটি পাটাতন। মঞ্চ হলে সেটি আরও উঁচু হতো।’

আগের দিন মঙ্গলবার ছাত্রদল, বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ও সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদসহ কোনো কোনো স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও ওঠে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ৷ সেদিন ‘ব্যান্ড পার্টিসহ’ ক্যাম্পাসে নির্বাচনী শোভাযাত্রা বের করেন বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর দুই মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্রঐক্য সমর্থিত যৌথ প্যানেল প্রগতিশীল ছাত্রঐক্যের প্রার্থীরা৷ শোভাযাত্রায় দুই জোটের কেন্দ্রীয় নেতারাও ছিলেন, যাঁরা ডাকসুর ভোটার বা প্রার্থী কোনোটিই নন। সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রচারণায় দেখা যায় সংগঠনটির আহ্বায়ক হাসান আল মামুনকে, যিনি ডাকসুর ভোটার বা প্রার্থী নন। এ ছাড়া, সেদিন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা যায় অছাত্রদের।

ডাকসু নির্বাচনের আচরণবিধির ৪(গ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোটার বা প্রার্থী ছাড়া অন্য কেউ কোনোভাবেই কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রচারণা চালাতে পারবেন না।’ আর ৩(ক) ধারা অনুযায়ী প্রচারণায় ব্যান্ড পার্টির ব্যবহার নিষেধ।

এর আগে গত শুক্রবার দিবাগত রাত তিনটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের বিভিন্ন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য নিজের কক্ষে ডেকে ‘চাপ’ দেন ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক। সেই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে তিনজন প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, সেদিন রাতে তাঁদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি। প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে হলে থাকতে তাঁদের সমস্যা হবে, এমন কথা বলে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন তাঁরা৷ পরে সেই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে দুইজন প্রার্থিতা প্রত্যাহারও করেন।

কোনো প্রার্থী বা ভোটারকে ভয় দেখানোর বিষয়ে ডাকসু নির্বাচনের আচরণবিধির ৯(গ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো প্রার্থী বা তাঁর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা ভোটারকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, বলপ্রয়োগ ও ভোটদানে বাধাগ্রস্ত করতে পারবেন না।’

তারও আগে গত ১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থাপনার দেয়ালে ছাত্রলীগ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হকের পক্ষে রঙিন ছবিসহ লিফলেট সাঁটা হয়। আচরণবিধির ৬(ক) ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো প্রার্থী নিজের সাদাকালো ছবি ছাড়া লিফলেট বা হ্যান্ডবিলে অন্য কারও ছবি বা প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন না। লিফলেট ছাপানো ও বিলি করা যাবে। আর ৬(খ) ধারায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও হল এলাকায় অবস্থিত কোনো প্রকার স্থাপনা, দেয়াল, যানবাহন, বেড়া, গাছপালা, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি বা অন্য কোনো দণ্ডায়মান বস্তুতে লিফলেট বা হ্যান্ডবিল লাগানো যাবে না। সেই লিফলেটগুলো এখনো সরানো হয়নি।

তবে জানতে চাইলে রেজওয়ানুল হক সেদিন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, কারা তাঁর পক্ষে লিফলেট লাগিয়েছে, তা তিনি জানেন না। ছাত্রলীগের কোনো নেতা-কর্মী এটি করে থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান তিনি৷

প্রশাসনের বক্তব্য

আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘প্রমাণসহ লিখিত অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’