নারীর বিপদে বন্ধুর হাত

ঘটনাটি গাইবান্ধার। ভালোবেসে বিয়ে করেন এক তরুণী। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন না যেতেই শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে দিশেহারা হয়ে যান ওই তরুণী। স্বামী থাকতেন চট্টগ্রামে। শেষে গত ১২ ফেব্রুয়ারি স্বামীর কাছে চট্টগ্রামে চলে আসেন তিনিও। স্বামী তাঁকে একটি স্থানে দাঁড় করিয়ে আসি বলে আর ফিরলেন না। অচেনা শহরে খোঁজাখুঁজি করেও স্বামীকে পাননি। চট্টগ্রামে পরিচিত কেউও ছিল না। তাঁর সেই বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ান ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের কর্মীরা।

রাস্তায় কান্নাকাটি করতে দেখে এক পুলিশ সদস্য তাঁকে নগরের ডবলমুরিং থানার ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠান। সেখানে আসার পর পুলিশ সদস্যরা ওই তরুণীর ভালোবাসার মানুষকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাননি।

পরে ওই তরুণীর মা-বাবাকে খবর দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁদের কাছে যেতেও রাজি নন। পরে তাঁকে কাউন্সেলিং করিয়ে মা-বাবার কাছে পাঠানো হয়। এখন ওই তরুণী পড়াশোনা করছেন।

তরুণী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে না গেলে হয়তো অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে যেতাম। নিজের ও জীবনের প্রতি এত বিরক্ত ছিলাম। এখন ভালো আছি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি।’

নির্যাতিত নারীদের নির্ভরতার জায়গা হয়ে উঠেছে ‘ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার’। এখানে আইনি–সহায়তা, কাউন্সেলিং, সমঝোতায় অসহায় নারীদের হাসি ফুটছে। সহিংসতার শিকার হলেই নারীরা ছুটে আসছেন সেবা নিতে। চালু হওয়ার পর থেকে পাঁচ বছরে সেবা নিয়েছেন ৯২৫ জন।

চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দাদের জন্য চট্টগ্রামে এটিই একমাত্র সেন্টার।

যৌতুকের জন্য নগরের বহদ্দারহাটে এক নারীকে মারধর করতেন তাঁর স্বামী। অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ওই নারী এক পরিচিতজনের মাধ্যমে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে আসেন ১১ ফেব্রুয়ারি। সেখান থেকে স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরে দুজনের মধ্যে সমঝোতা হয়। বাড়ি ফিরে যান ওই নারী।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে সরেজমিনে দেখা যায়, কেন্দ্রের দোতলা ভবনের প্রতি তলায় তিনটি করে কক্ষ রয়েছে। নিচতলায় অফিস কক্ষ ও খাবার রুম। দোতলায় নারী ও শিশুদের থাকার জন্য নয়টি শয্যা। রয়েছে শিশুদের খেলার জন্য বিশাল কক্ষ ও নানা খেলনা। কাউন্সেলিং ও চিকিৎসকের কক্ষ। তবে গতকাল সেখানে কোনো ভিকটিমকে পাওয়া যায়নি। গত তিন দিন ভিকটিম শূন্য রয়েছে এটি।

 ইউএনডিপির সহায়তায় পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির আওতায় এ কেন্দ্র ২০১৪ সালে চট্টগ্রামে তৈরি করা হয়েছিল। নির্যাতিত যেকোনো নারী বা শিশুর পাঁচ দিন বিনা খরচে এখানে থাকার সুযোগ রয়েছে। এ সময়ে তাকে আইনি–সহায়তা, কাউন্সেলিং ও স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়। যেখানে দিন–রাত ২৪ ঘণ্টা নির্যাতিত নারীরা তাঁদের যেকোনো সমস্যা নিয়ে যোগাযোগ করতে পারবেন। যোগাযোগের নম্বর ০৩১-৭২৭১৯৬, ০১৭৬৯৬৯০৪১১।

ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার চট্টগ্রামের দায়িত্বরত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক ইয়াছমিন আরা প্রথম আলোকে বলেন, এখানে সেবা নিতে মাসে গড়ে ৩০ থেকে ৩২ জন আসেন। বিশেষ করে নারীরা যৌতুকের জন্য নির্যাতন, স্বামীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের সমস্যা নিয়ে আসেন বেশি। প্রথমে উভয় পক্ষকে ডেকে সমঝোতার চেষ্টা করা হয়। ব্যর্থ হলে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার (লিগ্যাল এইড) মাধ্যমে বিনা খরচে মামলা পরিচালনা করা হয়।

এ ছাড়া প্রতারণার শিকার নারীরা এখানে এসে আশ্রয় ও আইনি–সহায়তা নিয়ে থাকেন। রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া শিশুদেরও এখানে রেখে সহায়তা করা হয়। অভিভাবক পেলে তুলে দেওয়া হয়।

প্রচারণার অভাবে নির্যাতিত অনেক নারী ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার সম্পর্কে জানেন না। নগর ও জেলার সর্বত্র প্রচারণা চালানোর মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অসচ্ছল পরিবারের অনেক নির্যাতিত নারী ও শিশু নানা সমস্যা নিয়ে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে আসছে। এ কেন্দ্রের মাধ্যমে তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সুগম হচ্ছে।