কতটা সুরক্ষিত দেশের প্রধান বিমানবন্দর

>

• হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর
• খেলনা পিস্তল নিয়ে বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা
• আট দিন পরে এবার আসল পিস্তল ও গুলি নিয়ে নিরাপত্তা তল্লাশি পার

আট দিনের ব্যবধানে একই বিমানবন্দরে দুটি ঘটনা। প্রথমটিতে একজন যাত্রী খেলনা পিস্তল ও বোমাসদৃশ বস্তু নিয়ে বিমানে উঠে সেটা ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন। পরের ঘটনায় গুলিসহ আসল পিস্তল নিয়ে আরেক যাত্রী ব্যাগ স্ক্যানিং ও নিরাপত্তা তল্লাশি পার হলেন, বিষয়টা ধরা পড়েনি। পরপর দুটি ঘটনা দেশের প্রধান বিমানবন্দর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

প্রথম ঘটনায় পাঁচ নিরাপত্তাকর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত এবং একজনকে প্রত্যাহার করা হয়। একটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। দেশের সব বিমানবন্দরে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার দ্বিতীয় ঘটনা। এখন এই প্রশ্ন সামনে এসেছে যে বিমানবন্দর আসলে কতটা সুরক্ষিত? যদিও পরের ঘটনায় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বিমানযাত্রীর ওপর দায় চাপাতে চাচ্ছে। আর এই যাত্রী হলেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।
‘নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন’–এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলছেন, তাঁর ল্যাপটপের ব্যাগে যে লাইসেন্স করা পিস্তলটি রাখা ছিল, সেটা তাঁর মনে ছিল না। গত মঙ্গলবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য তিনি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে যান। ব্যাগ স্ক্যানিং এবং নিরাপত্তা তল্লাশি শেষে বোর্ডিং পর্ব সম্পন্ন করেন। ফ্লাইটে ওঠার আগে দ্বিতীয় স্ক্যানিংয়ে যাওয়ার পর ল্যাপটপের ব্যাগে থাকা পিস্তলের কথা মনে হয় এবং তা তিনি নিরাপত্তাকর্মীকে জানান। এরপর সেটা নিয়ে নভোএয়ারের কাউন্টারে যান এবং যথানিয়মে তিনি যাত্রা করেন। এখন ইলিয়াস কাঞ্চন নিজের ভুল পরে শোধরালেও তাঁর উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, প্রথম স্ক্যানিংয়ে কেন অস্ত্রটি ধরা পড়ল না। এটা তিনি না হয়ে কোনো সন্ত্রাসী বা জঙ্গিও হতে পারত। তখন পরিস্থিতি কী হতো।

যদিও ইলিয়াস কাঞ্চনের বক্তব্য মানতে নারাজ কর্তৃপক্ষ। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) গতকাল বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বলেছে, এ বিষয়ে ইলিয়াস কাঞ্চনের বক্তব্য নিতান্তই তাঁর নিজস্ব। তাঁর বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থায় ত্রুটির বিষয়ে যেসব সংবাদ ছাপা হয়েছে, তা তথ্যভিত্তিক নয়। বেবিচক বলছে, শাহজালাল বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক টার্মিনালের নিরাপত্তাব্যবস্থা অত্যন্ত সুসংহত, নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য। নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করতে এবং বিভ্রান্ত না হতে সবার প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পরিচালক নূরে আলম সিদ্দিকী বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, বিমানে ওঠার আগেই আর্চওয়ে পেরোনোর সময় বা মেটাল ডিটেক্টর ব্যবহারের সময় নিরাপত্তারক্ষীরা বুঝতে পারেন, ইলিয়াস কাঞ্চন পিস্তল বহন করছেন। জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি সে কথা স্বীকার করেন।

তবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য যদি সঠিকও হয়ে থাকে, প্রথম স্ক্যানার ও নিরাপত্তা তল্লাশিতে তো গুলিসহ অস্ত্র ধরা পড়েনি। এর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টাকারীও একই বিমানবন্দরের একই নিরাপত্তাব্যবস্থা পার হয়ে নকল পিস্তল ও পাইপবোমাসদৃশ বস্তু নিয়ে ফ্লাইটে উঠেছিলেন, সেটা কোনো স্ক্যানার, আর্চওয়ে ও তল্লাশিতে ধরা পড়েনি। এরপর এক সপ্তাহ না পেরোতে এবং সর্বোচ্চ সতর্কতার মধ্যে আসল পিস্তলও ধরা পড়েনি।

এ বিষয়ে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সাবেক পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) এম কে জাকির হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্ছিদ্র নয়। এ ধরনের ঘটনা অন্যান্য দেশের বিমানবন্দরেও ঘটে। তবে দেখার বিষয়, ঘটনার পরপর যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নেওয়া হচ্ছে কি না। যেমন ঘটনার পরপর তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হচ্ছে কি না। কোনো ভুল হয়ে থাকলে সে ভুল যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, সে জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হলো কি না। এসব পদক্ষেপ যদি না নেওয়া হয়, তাহলে যে কোনো অনাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। জাকির হাসান বলেন, নিয়ম কানুন না মেনে কোনো সচেতন নাগরিকের অস্ত্র নিয়ে বিমানবন্দর দিয়ে যাতায়াতের চেষ্টা করাটাও অনাকাঙ্ক্ষিত।

বেবিচক সূত্র জানায়, বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়ে যাত্রীকে বিমানবন্দরে প্রবেশের প্রথম ফটকেই ঘোষণা দিতে হয়। তারপর নিরাপত্তাকর্মী অস্ত্রটি সংশ্লিষ্ট বিমান সংস্থার কর্মীদের দেবেন। যাত্রী চেক–ইন কাউন্টারে গিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র বহনসংক্রান্ত ফরম পূরণ করবেন। বিমানকর্মীরা ওই ফ্লাইটের পাইলটের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র একটি বাক্স ও গুলি অপর একটি বাক্সে ভরে সিলগালা করে দেবেন। পাইলট বাক্স দুটি নিজের কাছে রাখবেন। গন্তব্যে পৌঁছার পর যাত্রী বিমান সংস্থার কাউন্টার থেকে বাক্স দুটি বুঝে নেবেন।

বিমানবন্দর–সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ইলিয়াস কাঞ্চনের ঘটনায় নিরাপত্তাকর্মীর স্ক্যানিং মেশিনের কাজে দক্ষতা ও পেশাদারিতে ঘাটতি ছিল। গতকাল বেসরকারি বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, নিজের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে ইলিয়াস কাঞ্চন সংবাদমাধ্যমে ‘একের পর এক অসত্য’ কথা বলছেন। মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘প্রকৃতপক্ষে ওই দিন হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে যা ঘটেছে তা হলো, ইলিয়াস কাঞ্চনের ল্যাপটপের ব্যাগে থাকা পিস্তল ও গুলি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের অ্যান্টি–হাইজ্যাকিং পয়েন্টে স্ক্যানিং করার সময় তা মেশিনে শনাক্ত হয়। বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি তাঁর ভুল স্বীকার করেন। তখন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা তাঁকে বিমানবন্দরের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পিস্তলটি বহন করার জন্য অনুরোধ করলে তিনি ওই স্থান থেকে ফেরত যান। পরে তিনি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিমানে চট্টগ্রামে গমন করেন।’

এ বিষয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, কর্তৃপক্ষ যেসব কথা বলছে, এটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। বিমানবন্দরে তো ভিডিও ফুটেজ আছে। সিসি ক্যামেরা ফুটেজ দেখেও তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। চাইলে সেই ফুটেজ প্রকাশ করতে পারেন। তখন কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা, প্রমাণ হয়ে যাবে।

প্রসঙ্গত, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ঘাটতির কথা বলে ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া এবং ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ থেকে সরাসরি মাল পরিবহনে (কার্গো) নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এরপর রেডলাইন নামে বিমানবন্দর নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যের একটি কোম্পানি এখানকার বিমানবন্দর কর্মীদের স্ক্যানিং ও নিরাপত্তা তল্লাশির ওপর প্রশিক্ষণ দেয়। অস্ট্রেলিয়া ২০১৬ সালে এবং যুক্তরাজ্য ২০১৮ সালে কার্গোর ওপর ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেও নেয়।

বর্তমানে দেশের প্রধান বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা সুরক্ষিত—এ প্রশ্নের জবাবে গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) এম কে জাকির হাসান বলেন, বর্তমান নিরাপত্তাব্যবস্থা পাঁচ বছর আগের চেয়ে অনেক ভালো। কারণ হচ্ছে, স্ক্যানিংয়ের জন্য সেসব আধুনিক সরঞ্জাম দরকার, এখন সবই আছে। আগে ছিল সিঙ্গেল ভিউ এক্স-রে মেশিন, এখন ডুয়েল ভিউ এক্স-রে মেশিন এসেছে। বিস্ফোরক শনাক্ত করার কোনো মেশিন আগে ছিল না, এখন এ জন্য দুই ধরনের মেশিন আছে। মাঝেমধ্যে ডগ স্কোয়াড দিয়ে তল্লাশি করা হয়। বিদেশি প্রতিষ্ঠান দিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। অনেক সিসিটিভি লাগানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এখন মূল নজর দেওয়ার বিষয়, যাদের নিয়োগ দিচ্ছি ডিউটি করা জন্য, তারা সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে কি না, তাদের ওপর নজরদারিটা ঠিকভাবে হচ্ছে কি না, এটা নিশ্চিত করা গেলে এই বিমানবন্দরে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না।’