নারীর জীবন বদলে দেওয়া ৫ উদ্ভাবন

>

• নারীর অগ্রযাত্রায় অবদান রেখেছে ৫ উদ্ভাবন
• এগুলোর মধ্যে আছে বাইসাইকেল, ইন্টারনেট, স্যানিটারি প্যাড
• ফেব্রুয়ারি মাসে ৫টি উদ্ভাবনের কথা জানায় ইউএন উইমেন

বিশ্বজুড়ে নারীর অগ্রযাত্রায় অবদান রেখেছে এমন পাঁচটি উদ্ভাবন কী—চট করে এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যে কারও জন্যই কঠিন। কিছুক্ষণ মাথা খাটালে নিশ্চয়ই উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে। নারীর অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থা ইউএন উইমেন পাঁচটি উত্তর খুঁজে বের করেছে। সংস্থাটি মনে করে, নারীর জীবন বদলে দেওয়া পাঁচটি উদ্ভাবন হলো—হিপ্পো রোলার (পানি সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত চাকাযুক্ত একধরনের ড্রাম), বাইসাইকেল, ইন্টারনেট, স্যানিটারি প্যাড ও প্যান্ট।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রাখে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই পাঁচটি উদ্ভাবনের কথা জানায় ইউএন উইমেন। সংস্থাটি বলেছে, এসব উদ্ভাবন নারীর জীবনকে সহজ করেছে, স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে, তার চলাচলের গতি বাড়িয়েছে, নারীকে বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত হতে সহায়তা করেছে। এসব উদ্ভাবন প্রথাগত ধারণা বদলাতে ও লিঙ্গসমতার আবহ তৈরিতে সহায়তা করেছে।

ইউএন উইমেনের এই মূল্যায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আয়েশা বানু প্রথম আলোকে বলেন, এসব উদ্ভাবন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সব উদ্ভাবন বিশ্বের সব এলাকার নারীদের জন্য সমান সুফল এনে দেয় না।

গতকাল ৮ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য: সবাই মিলে ভাবো, নতুন কিছু করো, নারী-পুরুষ সমতার নতুন বিশ্ব গড়ো। এ বছরের প্রতিপাদ্যে নতুন উদ্ভাবনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

হিপ্পো রোলার
হিপ্পো রোলারের উদ্ভাবন আফ্রিকার গ্রামীণ নারীদের পানি সংগ্রহের কষ্ট কমিয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে এখন বিশ্বের প্রায় ২১০ কোটি মানুষ সহজপ্রাপ্য নিরাপদ পানির সংকটে আছে। পানির এই সংকট সবচেয়ে বেশি মোকাবিলা করতে হয় নারীদের, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের নারীদের। পানি সংগ্রহের জন্য নারীকে লম্বা পথ পাড়ি দেওয়ার নির্যাতন সহ্য করতে হয় এবং দিনের একটি বড় সময় চলে যায় এই কাজে। পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে নারীরা উপার্জনক্ষম কাজে যুক্ত হতে পারে না, স্কুলে যেতে পারে না বা খেলার সময় পায় না।

দক্ষিণ আফ্রিকার দুই ব্যক্তি গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে ‘আকুয়া রোলার’ উদ্ভাবন করেন, সাধারণভাবে এটাই হিপ্পো রোলার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। স্থানান্তরযোগ্য ব্যারেল আকৃতির ড্রাম ভূমির ওপর দিয়ে গড়িয়ে নেওয়া যায়। সনাতন পাত্রের চেয়ে এতে পাঁচগুণ বেশি পানি নেওয়া যায়। নিতে পরিশ্রম কম হয়। এই উদ্ভাবন ২০ টির বেশি দেশের মানুষের জীবনে পরিবর্তন এনেছে।

বাইসাইকেল
বাইসাইকেল উদ্ভাবন নারীকে অধিকতর চলাচল ও স্বাধীনতার সুযোগ দিয়েছে। নারীর শারীরিক ক্ষমতা কম—এই গৎবাঁধা ধারণা ভেঙে দিয়েছে এবং পোশাকের ধরনে পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ১৮৮০ সালে আধুনিক বাইসাইকেল উদ্ভাবন করেন একজন ইংরেজ প্রকৌশলী। সেটি ছিল নারীবাদের প্রথম ঢেউয়ের সময়। তবে নারীর চলাচলের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করে বাইসাইকেল উদ্ভাবন করা হয়নি। অভিভাবকদের সঙ্গে বা ঘোড়ার গাড়িতে বা ঘোড়ার পেছনে বসে নারীদের চলাচলের যে রীতি ছিল বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে, তাতে পরিবর্তন আনে বাইসাইকেল।

তবে নারীদের বাইসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে বাধা আসে বিশ্বের অনেক অঞ্চলে। ১৮৯৪-৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একজন নারী বাইসাইকেল নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণে বের হয়। এরপর ধীরে ধীরে নারীদের কাছে বাইসাইকেল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

ইন্টারনেট
বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত ও উদ্দীপ্ত হতে নারীর জন্য উন্মুক্ত পরিসর তৈরি করেছে ইন্টারনেট। নারীকে স্বাধীনভাবে নিজের মতপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছে ইন্টারনেট। এর মাধ্যমে একজন নারী সক্রিয় কর্মীর ভূমিকা পালন করতে পারছে, নিজস্ব একটি গোষ্ঠীতে যুক্ত হতে পারছে, শিখতে পারছে, নিজের পেশাও বেছে নিতে পারছে। একই সঙ্গে নারীর সচেতনতা বাড়ছে, নারী অধিকার আন্দোলনে যুক্ত হতে পেরেছে। ইন্টারনেট নারীকে ব্যবসা বা রাজনীতির প্রচারণা বা আরও অনেক কিছু করা সুযোগ বাড়িয়েছে। হ্যাশট্যাগ মি টু বা হ্যাশট্যাগ টাইমসআপের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আন্দোলন লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়গুলো অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি উন্মোচিত করেছে এবং কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করছে।

তবে অন্য যেকোনো প্রযুক্তির মতো ইন্টারনেটেরও কিছু খারাপ দিক আছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আয়েশা বানু। তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেটের মাধ্যমে নারী নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছে, হেনস্তার শিকার হচ্ছে—এই বিষয়গুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।’

স্যানিটারি প্যাড
নারীর স্বাস্থ্যের উন্নতিতে বিরাট অবদান রেখেছে স্যানিটারি প্যাড। এটি সামাজিক কাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়িয়েছে।
মাসিকের সময় নারী কী ব্যবহার করবে—উল, শেওলা, পশুর চামড়া নাকি পুরোনো ন্যাকড়া বা সংবাদপত্র? প্রশ্ন অদ্ভুত শোনাতে পারে। তবে আরও অদ্ভুত হচ্ছে মাসিকের সময় নারীকে নির্জন স্থানে রাখা হতো, নোংরা আখ্যা দেওয়া হতো।

জখম হওয়া সৈন্যদের রক্ত ঝরা বন্ধ করতে এক শ বছরের কিছু আগে ফরাসি নার্সরা স্যানিটারি প্যাড উদ্ভাবন করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে স্যানিটারি প্যাডের প্রথম বাণিজ্যিক আবির্ভাব ঘটে। নারীদের কাছে পৌঁছাতে এবং নারীরা এতে অভ্যস্ত হতে আরও কয়েক দশক সময় লাগে। এই যুগান্তকারী উদ্ভাবন নারী ও কিশোরীর স্বাস্থ্যের উন্নতির ঘটনায়। এতে স্কুলে মেয়েদের উপস্থিতি বাড়িয়ে দেয়, কাজ ও উপার্জনের সুযোগ বৃদ্ধি করে।

বাংলাদেশেও বহু নারী তাদের প্রয়োজনের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে পারে না এর মূল্যের কারণে। নারীর মাসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গবেষণা করেছে ওয়াটার এইড বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটির এ দেশীয় পরিচালক খায়রুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় স্যানিটারি প্যাডের ওপর আরোপিত কর কমানো উচিত সরকারের। তাঁর পরামর্শ হচ্ছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের বার্ষিক কেনাকাটার তালিকায় প্যাড রাখতে পারে। এই প্যাড স্বল্পমূল্যে দরিদ্র নারীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।

প্যান্ট
নারীরা প্যান্ট পরা শুরু করার পর নারী সম্পর্কে গৎবাঁধা ধারণা পাল্টাতে থাকে। তবে নারীরা পুরুষের মতো প্যান্ট পরবে কি না তা নিয়ে কয়েক শতাব্দীজুড়ে মতবিরোধ ছিল। যেসব কাজ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শুধু পুরুষের বলে ধরে নেওয়া হতো, সেসব কাজে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নারীরা যুক্ত হতে শুরু করে। মূলত তখন থেকেই ব্যাপক পরিসরে নারীদের মধ্যে প্যান্ট পরার প্রচলন বেড়ে যায়, এমনটিই বলছে ইউএন ইউমেন। সংস্থাটি বলছে, কাজের দুনিয়া বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীর পোশাকেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। নারীরা নতুন পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং আজকে এই পোশাক ক্ষমতারও প্রতীক। দারিদ্র্যপীড়িত অনেক দেশের কারখানায় নারী শ্রমিকেরা ঢিলেঢালা প্যান্ট পরে কাজ করে, সেটি ফ্যাশনের জন্য নয়। এই প্যান্ট পরে তারা কাজে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

তবে প্যান্ট পরা নিয়ে বিতর্কের অবসান এখনো হয়নি। এ বিষয়ে অধ্যাপক আয়েশা বানু বলেন, ‘যে পোশাক নারীকে স্বাচ্ছন্দ্য দেয়, সেই পোশাকই তার পরা উচিত, হোক সে শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ। কোনো পোশাকই চাপানো উচিত নয়।’