সহিংসতা বলতে মারধরকেই বোঝেন নারী-পুরুষেরা

>

• স্বামীর হাতে ধর্ষণ অনেকেই নির্যাতন মনে করেন না
• স্বামীর বকাঝকাও স্বাভাবিক হিসেবে নেন
• উত্যক্তকরণকে তাঁরা যৌন হয়রানি বলছেন

নারী-পুরুষের একটি বড় অংশ সহিংসতা বলতে মারধরকেই বোঝেন। প্রায় কেউই স্বামীর হাতে ধর্ষণের ঘটনাকে নির্যাতন মনে করেন না। স্বামীর বকাঝকাও স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে নেন। তবে উত্ত্যক্তকরণকে তাঁরা যৌন হয়রানি বলছেন।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের একটি জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কে মানুষের ধারণা জানতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশের ৪ হাজার ৮০০ নারী-পুরুষের মধ্যে এই জরিপ চালানো হয়। যেখানে উত্তরদাতা নারী-পুরুষের হার ছিল সমান।

জরিপের তথ্য আরও বলছে, গণমাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতার খবর উপস্থাপন নিয়ে ৯১ শতাংশ মানুষ অসন্তুষ্ট। পাশাপাশি পপুলার কালচারে নারীকে খাটো করে উপস্থাপনের কারণে নির্যাতন বাড়ছে।

এ বিষয়ে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির প্রথম আলোকে বলেন, নারীকে নানাভাবে নির্যাতন-হেনস্তা করা হয়। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা দৃশ্যমান না হয়, অর্থাৎ যা খালি চোখে না দেখা যায়, তাকে সহিংসতা মনে করা হয় না। নারী-পুরুষ উভয়কে এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কেননা এর নেতিবাচক প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

জরিপে অংশ নেওয়া নারী-পুরুষের ৪০ শতাংশ নারীর প্রতি সহিংসতা বলতে শুধু মারধরকেই বোঝেন। তবে ৭ শতাংশ মারধরের ভয় দেখানোকেও সহিংসতা বলছেন।

চাকরিজীবী স্বামী অফিসে যাওয়ার সময় ঘড়ি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন এ নিয়ে স্ত্রীকে স্বামী বকাঝকা করেন। রাগ করেন, মেজাজ দেখিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান। রোজগেরে স্বামীর বকাঝকাকে অর্ধেকের বেশি নারী-পুরুষ নির্যাতন বলছেন না। তবে প্রতি ১০ জনে ৬ জন যৌতুকের জন্য চাপ, তালাকের হুমকি বা কথা বলা বন্ধ করাকে মানসিক নির্যাতন বলছেন।

উত্ত্যক্ত, যৌন নির্যাতন
স্বামীর হাতে ধর্ষণের ঘটনাকে মাত্র ৪ শতাংশ উত্তরদাতা যৌন নির্যাতন বলছেন। অন্যদিকে উত্ত্যক্তকরণকে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের তিন-চতুর্থাংশ নারী-পুরুষ যৌন নির্যাতন বলছেন। বাকিরা উত্ত্যক্তকরণকে স্বাভাবিক আচরণ বা মজা হিসেবে দেখছেন।

স্কুলে যাতায়াতের সময় নিয়মিতভাবে স্থানীয় এক যুবকের দ্বারা উত্ত্যক্তের শিকার হয় এক ছাত্রী। বিষয়টি বাবাকে জানালে পরবর্তী সময়ে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় প্রতিবাদ করতে নিষেধ করেন। বাবার এ সিদ্ধান্তকে ৮০ শতাংশ নারী-পুরুষ ভুল মনে করছেন।

গণমাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা
গণমাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতার খবর উপস্থাপন নিয়ে প্রতি ১০ জনে ৯ জন অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা এ ধরনের খবরে রগরগে বর্ণনা দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ এবং আক্রান্তের নাম-পরিচয় প্রকাশ না করতে বলেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন, ‘জরিপে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে আমরা যাঁরা গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ করি, তাঁদের মতামত কাছাকাছি। আক্রান্তের সরাসরি নাম না বললেও যেভাবে বর্ণনা দেওয়া হয়, তাতে দূর থেকে আক্রান্তকে চেনা না গেলেও স্থানীয়দের কোনো সমস্যা হয় না। অনেক সময় আক্রান্তের সঙ্গে কথা না বলে পুলিশের দেওয়া তথ্য দিয়ে সংবাদ তৈরি করা হয়, যাতে ঘটনার খণ্ডিত অংশ উঠে আসে। তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যমকর্মীদের উচিত আরও দায়িত্বশীলভাবে সংবাদ উপস্থাপনের, যাতে আক্রান্ত সুরক্ষিত থাকবে, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হবে।

জরিপের শেষাংশে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ার কারণ হিসেবে মোটা দাগে মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করছেন নারী-পুরুষেরা। এর পাশাপাশি পপুলার কালচার অর্থাৎ নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন কিংবা ইউটিউবে নারীকে আপত্তিকরভাবে বা খাটো করে উপস্থাপন এবং পর্নোগ্রাফির কারণেও নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা এবং রূঢ় আচরণ বাড়ছে বলছেন ৬৫ শতাংশ নারী-পুরুষ।

এ বিষয়ে ব্র্যাকের পরিচালক (যোগাযোগ) মৌটুসী কবীর বলেন, পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা এবং সংস্কৃতি মিলে তৈরি হয় মূল্যবোধ। সেখানে সব সময়ই পিতৃতান্ত্রিকতার জয়জয়কার। এর পরিবর্তন দরকার। তিনি আরও বলেন, সচেতনতা বৃদ্ধি ও আইনের প্রয়োগ দুটিই একসঙ্গে হতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।