প্রাথমিক তদন্তের পর থেমে গেল পুলিশ

ইশরাক আহম্মেদ
ইশরাক আহম্মেদ

থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। অন্য সময় হলে এই বৃষ্টিতে ছেলেকে বেরোতে দিতেন না মা নাসরিন আক্তার। আবদারটা রাখতে হলো, কারণ, কদিন বাদেই ইশরাককে আবার কানাডায় ফিরতে হবে। জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে মা দেখলেন ছেলে বাসার উল্টো দিকের রেস্তোরাঁয় ঢুকছে। সেই থেকে ছেলের আর কোনো খোঁজ পাননি তিনি।
নাসরিন আক্তার ও জামালউদ্দীন দম্পতির বড় ছেলে ইশরাক আহম্মেদ ২০১৭ সালের ২৬ আগস্ট রাত সাড়ে আটটা থেকে নিখোঁজ। কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ইশরাক সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এসেছিলেন। ২ সেপ্টেম্বর কোরবানি ঈদের রাতে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। ভিডিও ফুটেজে সবশেষ সাতমসজিদ সড়কের ফুটপাতে দেখা গেছে। ওখান থেকে হেঁটে বাসায় পৌঁছাতে সময় লাগার কথা দুই থেকে আড়াই মিনিট। কিন্তু ১৯ মাস পরও ইশরাক আহম্মেদ আর বাড়ি পৌঁছাতে পারেননি।
ইশরাক আহম্মেদ তাহলে কোথায়? জামালউদ্দীন তাঁর ছেলের খবর জানেন ২০১৭ সালের ২৬ আগস্ট বিকেল পর্যন্ত। ইশরাক বিকেল পাঁচটার দিকে ধানমন্ডি ১৯ নম্বরে তাঁদের বাসার উল্টো দিকে লাবাম্বায় ঢুকেছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে খুশবু নামের আরেকটি রেস্তোরাঁয় যান। রাত আটটার পর নাসরিন আক্তার ছেলের ফোন বন্ধ পেয়ে খোঁজখবর শুরু করেন। জানতে পারেন, অন্য বন্ধুরা বাসায় ফিরে গেছেন। সে রাতেই জামালউদ্দীন আত্মীয়স্বজনের পরামর্শে ধানমন্ডি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর দিন সাতেক ধানমন্ডি থানা ও ডিবির কর্মকর্তাদের আন্তরিক বলে মনে হয়েছে। কিন্তু একটা পর্যায়ে তাঁরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। ধানমন্ডি থানায় জিডি করার আগেই র‍্যাব-২-এর অধীন সিপিসি-১-এর একটি গাড়ি তাঁর বাসায় আসে। পরদিন সকালে সিপিসি-১-এর সে সময়কার উপসহকারী পরিচালক গাজী জাহিদুল হাসান বাসা থেকে ইশরাক আহম্মেদের ল্যাপটপ নিয়ে যান। তাঁর বাসায় পুলিশ ছাড়াও সিপিসি-১-এর তৎকালীন অধিনায়ক মেজর মো. আতাউর রহমান আসেন। পুরো ঘটনার নজরদারি করে র‍্যাব-২। এর মধ্যে পুলিশের একটি প্রভাবশালী সূত্র ছেলেকে খুঁজে দেওয়ার কথা বলে টাকা নেয় এবং কয়েক দিনের মাথায় অপারগতা জানিয়ে সেই টাকা ফেরত দেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা দুই কোটি টাকা দাবি করেন। তাৎক্ষণিকভাবে অত টাকা দিতে পারবেন না বলে জানান জামালউদ্দীন। বিষয়টি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে জামালউদ্দীন জানান, মিরপুরের একজন সাংসদের আত্মীয়ের কাছ থেকে তিনি টাকা পান। আর তাঁর গ্রামের বাড়িতে সাংসদ তাঁর ওপর বিরক্ত ছিলেন। দান-খয়রাত করেন বলে তিনি আশঙ্কা করছিলেন, জামালউদ্দীন নির্বাচন করবেন। তাঁকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, তিনি নির্বাচন করবেন না।
এখন পর্যন্ত জামালউদ্দীন ও তাঁর স্বজনেরা নিয়মিত বিরতিতে থানা ও র‍্যাবের কার্যালয়ে যাচ্ছেন। অনেকে আর কথা বলতে চান না। ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কেউ নিখোঁজ থাকলে পুলিশ খুঁজে দেখার চেষ্টা করে। র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খানও বলেছেন একই কথা।

কে কী বলছে
ধানমন্ডি থানার পুলিশ জিডিটি হওয়ার পর ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ ও ইশরাকের কল রেকর্ড সংগ্রহ করে তাঁর অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা করে। ডিবি ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমও ওই তদন্তে যুক্ত ছিল। তবে কল রেকর্ড হাতে পাওয়ার পর পুলিশের সক্রিয়তা কিছুটা কমে আসে।
ডিবির একটি ওয়াকিবহাল সূত্রের সঙ্গে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি কথা হচ্ছিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কেউ নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কোনো একটির সম্পৃক্ততা থাকলে অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আর সেদিকে আগায় না।
র‍্যাব-২-এর সিপিসি-১-এ ইশরাক সম্পর্কে তদন্তের কোনো কাগজপত্র নেই। র‍্যাব-২-ও কিছু বলতে পারছে না। এমনকি কার কাছ থেকে খবর পেয়ে সেই রাতে র‍্যাব জামালউদ্দীনের বাসায় গিয়েছিল, সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য তাঁরা দিতে পারেননি।
ইশরাকের বাবা জামালউদ্দীন সারা দিন ইশরাকের কী দোষ ছিল, এই প্রশ্নের জবাব খোঁজেন। তাঁর ধারণা, অপহরণকারী সে যে-ই হোক না কেন, তারা ভাড়া খেটেছে। ধারণা করেছে, তিনি খুব ধনবান।