ছাত্ররাজনীতিতে নতুন ধারা

এবার ডাকসুর বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ পদে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রার্থীরা প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন।
এবার ডাকসুর বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ পদে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রার্থীরা প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন।
>

• প্রথাগত ছাত্রসংগঠনের বাইরের প্রার্থীরা মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায়
• নির্বাচনে কোনো অবস্থানই তৈরি করতে পারেনি ছাত্রদল
• শূন্যতা পূরণ করেছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা

স্বাধীনতার পরে যতবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে, তার সব কটিতেই বিজয়ী হয়েছেন সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রার্থীরা। কিন্তু এবার প্রথাগত বিরোধীদলীয় ছাত্রসংগঠনগুলো জয়ী হওয়া তো দূরের কথা, মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলতে পারেনি। সেখানে চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আলোচিত ছাত্রনেতা মো. নুরুল হক সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

শুধু তা-ই নয়, ডাকসুর জিএস-এজিএসসহ বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ পদেই প্রথাগত ছাত্রসংগঠনগুলোর বাইরে গিয়ে এই কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রার্থীরা প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন। একটি সম্পাদকীয় পদে জিতেছেনও।

আবার ১৮টি হল সংসদ নির্বাচনে ১২টিতে ভিপি পদে ছাত্রলীগ জয়ী হলেও বাকি ছয়টি হলে ভিপি পদে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এখানেও ছাত্রলীগের বাইরে প্রথাগত ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রার্থীরা পিছিয়ে রয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা ও শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন হলো, এর মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিতে নতুন প্রবণতা শুরু হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে সত্যিকারভাবে কাজ করলে যে শিক্ষার্থীদের সমর্থন পাওয়া যায়, তার প্রমাণ রেখেছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। আবার এটাও ঠিক যে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের বাইরে অন্যান্য বিরোধী মতের ছাত্রসংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে কার্যক্রম চালাতে পারেনি। সেই শূন্যতা পূরণ করেছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা।

ডাকসুর সাবেক জিএস মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের এই নির্বাচনে জেতা বা মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিতে একটা নতুন ধারা শুরু হলো। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর কাছে একধরনের জিম্মি ছিল ক্যাম্পাস। এখনো আছে। অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা হলে থাকতেও পারেননি। ফলে সেই শূন্যতা পূরণ করেছেন কোটা আন্দোলনকারীরা। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনকে যারা পছন্দ করে না, তাদের সমর্থন নিয়েই মূলত এই প্ল্যাটফর্ম হয়েছে এবং এত কিছুর পরও তারা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এসেছে।

বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও এই নির্বাচনে ছাত্রদল কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারেনি। ছাত্রদলের প্রার্থীদের মধ্যে সম্পাদকীয় একটি পদ ছাড়া কেউ হাজারের ওপরে ভোট পাননি।

জিএস-এজিএসসহ ডাকসুর ২৫টি পদের মধ্যে ছাত্রলীগ ২৩টিতে জয়ী হলেও সব ছাপিয়ে ভিপি পদে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হকের বিজয়ী হওয়ার বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। ছাত্রলীগ এই পদে পুনরায় নির্বাচনের দাবিতে ফল ঘোষণার পর থেকেই বিক্ষোভ করেছে। মঙ্গলবারও তারা উপাচার্যের বাড়ির সামনে প্রায় দিনভর বিক্ষোভ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক ও তাঁর সহকর্মীদের ধাওয়াও করেছে ছাত্রলীগ। অবশ্য ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী বিকেলে টিএসসিতে গিয়ে নুরুল হকের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। এতে ক্যাম্পাসে উত্তেজনার পারদ কমলেও ছাত্রলীগের ভেতরে এ নিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে।

বিভিন্ন আবাসিক হল সংসদ নির্বাচনে জয়ী ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন প্রার্থীর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁদেরও মূল্যায়ন হলো, কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে নুরুল হকের প্রতি শিক্ষার্থীদের সহানুভূতি কাজ করেছে। তবে তাঁরা মনে করছেন, ভেতর থেকে ছাত্রলীগের একটি অংশ সংগঠনের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরীকে ভোট দেয়নি। ভিপি পদে রেজওয়ানুল পেয়েছেন ৯ হাজার ১২৯ ভোট, আর নুরুল হক ১১ হাজার ৬২ ভোট পেয়েছেন। তাঁরা বলছেন, জিএস পদে বিজয়ী ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ও এজিএস পদে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন যত ভোট পেয়েছেন, দলের সভাপতি তার চেয়ে কম ভোট পেয়েছেন।

ছাত্রলীগের কোন্দল ও আঞ্চলিকতার কারণেই ভিপি প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন বলে দলে আলোচনা চলছে। তবে বেশ কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী এবং ছাত্রসংগঠনের কর্মী প্রথম আলোকে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে জনপ্রিয় হওয়ায় আগে থেকেই নুরুল হক জেতার বিষয়ে আলোচনায় ছিলেন।

ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, জিএস পদে জিতেছেন ছাত্রলীগের গোলাম রাব্বানী (ভোট ১০,৪৮৪)। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান (ভোট ৬,০৬৩)। এই পদে স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদের প্রার্থী এ আর এম আসিফুর রহমান তৃতীয় হয়েছেন। তিনি ভোট পেয়েছেন ৪,৬২৮টি। রাশেদ ও আসিফের ভোট ভাগাভাগি হওয়ায় ছাত্রলীগের গোলাম রাব্বানীর জয়টি সহজ হয়েছে বলে ক্যাম্পাসে আলোচনা আছে।

এজিএস পদে জিতেছেন ছাত্রলীগের সাদ্দাম হোসেন। তিনি সহজে জয়ী হবেন বলে আগে থেকেই ক্যাম্পাসে আলোচনা ছিল। তিনি সবচেয়ে বেশি ১৫ হাজার ৩০১ ভোট পেয়েছেন। এই পদেও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হোসেন।

সমাজসেবা সম্পাদক পদে জিতেছেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রার্থী আখতার হোসেন। এ ছাড়া স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক এবং আন্তর্জাতিক সম্পাদকসহ বেশির ভাগ পদেও জয়ী ছাত্রলীগের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রার্থী।

ভিপি পদে কয়েকটি বাম সংগঠনের মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্যের আলোচিত প্রার্থী লিটন নন্দী পেয়েছেন ১ হাজার ২১৬ ভোট। স্বতন্ত্র জোটের ভিপি প্রার্থী অরণি সেমন্তি খান পেয়েছেন ২ হাজার ৬৭৬ ভোট।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ প্রথম আলোকে বলেন, এখানে শিক্ষার্থীরা যাঁদের ভোট দিয়েছেন, তাঁরাই জিতেছেন। নির্বাচন নিয়ে যৎসামান্য উত্তেজনা থাকলেও দুই ভিপি প্রার্থী শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন, এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।

প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই ছাত্রদল
রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। ১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের জেরে ডাকসুতে বড় বিজয় পেয়েছিল। কিন্তু এবারের নির্বাচনে ছাত্রদল ডাকসুর ২৫টি পদের একটিতেও জয় পায়নি। ১২টি সম্পাদকীয় পদের মাত্র একটিতে ছাত্রদলের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পেরেছেন। কমন রুম ও ক্যাফেটেরিয়া বিষয়ক সম্পাদক পদে ছাত্রদলের কানেতা ইয়া লাম-লাম দ্বিতীয় হয়েছেন।

ভিপি পদে এই সংগঠনের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান মাত্র ২৪৫ ভোট পেয়ে পঞ্চম হয়েছেন। এই সংগঠনের জিএস প্রার্থী আনিসুর রহমান খন্দকার ৪৬২ ভোট পেয়ে ষষ্ঠ হয়েছেন।

১৮টি হল সংসদের কোনো পদেও ছাত্রদল জয় পায়নি। প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও ছিল না। হল সংসদগুলোতে ২৩৪টি পদের বিপরীতে ছাত্রদলের প্রার্থী ছিলেন মাত্র ৫৪ জন।

ছাত্রদলের একাধিক নেতা ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছাত্র অধিকারসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে ছাত্রদল সক্রিয় ছিল না। আবার সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই অছাত্র ও বয়স্ক। এসব কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি।

 বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রদল ১০ বছর ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি। কী কারণে যেতে পারেনি, তা জাতি ও ছাত্রসমাজ জানে। এর সুযোগ নিয়ে ছাত্রলীগ কারচুপি ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে।

ছাত্রদলের চেয়ে ডাকসু ও বিভিন্ন হল সংসদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেশি ভালো ফল করেছেন। এ বিষয়ে শহীদ উদ্দীন বলেন, ছাত্রদল ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি বলেই সাধারণ ছাত্ররা সে জায়গাটা নিয়েছেন।

কেন কোটা আন্দোলনকারীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়?
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কোটা সংস্কারের দাবিটি ছিল শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। যে কারণে এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিপুল সমর্থন ছিল। ক্ষমতাসীনদের কঠোর অবস্থান, হামলা-মামলার মুখে শেষ পর্যন্ত দাবি আদায়ে সফল হওয়ায় শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের আস্থায় ছিল এই পরিষদ। আবার হলগুলোতেও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের বিপক্ষে ভেতরে ভেতরে একটি অবস্থান ছিল।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গত ১০ বছরে হলগুলোতে ছাত্রলীগের বাইরে অন্য ছাত্রসংগঠনগুলো তৎপরতা চালাতে পারেনি, সম্ভবও ছিল না। অন্যদিকে চাকরিতে কোটা সংস্কারের মতো জীবিকা-সম্পর্কিত অধিকার নিয়ে আন্দোলন করে জনপ্রিয় হয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। কাজেই তাঁরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন পেয়েছেন। তাঁর মতে, আগে রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে যাঁরা আন্দোলন করেছেন, তাঁরাই ডাকসুতে জয়ী হয়েছেন। এখন জীবিকার অধিকার নিয়ে আন্দোলন করা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা জয় পেয়েছেন।