নতুন নতুন পরিস্থিতিতে আরও দুর্দশায় বিএনপি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ঘুরে দাঁড়াতে তিনটি বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। তা হচ্ছে খালেদা জিয়ার কারামুক্তির আন্দোলন জোরদার, ভোটের আগে হামলা-মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত নেতা-কর্মীদের পুনর্বাসন এবং দলকে পুনর্গঠন। নির্বাচনের দুই মাস পার হলেও কোনো কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়নি; বরং দল ও জোটের অভ্যন্তরীণ নতুন নতুন পরিস্থিতিতে আরও দুর্দশায় পড়েছে বিএনপি

সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের পর ছাত্রদলকে নিয়ে লজ্জাজনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন বিএনপির নেতারা। ডাকসুতে ছাত্রদল পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দিতে পারেনি। উপরন্তু যাঁদের প্রার্থী করা হয়েছিল, তাঁরা অতি নগণ্য ভোট পাওয়াটা আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থি​তিতে নিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে ছাত্রদলের আগামী কমিটি করার চিন্তা করা হচ্ছে।

দলীয় শৃঙ্খলা নিয়েও হতাশাজনক পরিস্থিতিতে পড়েছে বিএনপির নীতিনির্ধারণী মহল। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় এ পর্যন্ত ১২১ জনকে বহিষ্কার করতে হয়েছে। এ নিয়ে দলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। কেউ বলছেন, দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ সরকারের অধীন নির্বাচনে না যাওয়ার। নির্বাচনে যাওয়ার পরিণতিও সবাই জানে। তাই বহিষ্কার সিদ্ধান্ত সঠিক। আবার কেউ কেউ বলছেন, এভাবে মাঠপর্যায়ের নেতাদের গণহারে বহিষ্কার দলকে দুর্বল করবে। পরে এই বহিষ্কারাদেশ তুলতে এক গোষ্ঠীর পকেট ভারী হবে।

বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে দলের এমন পরিস্থিতির কথা জানা গেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, এখনকার যে পরিস্থিতি, তাতে ভোটের আগে ক্ষতিগ্রস্ত নেতা-কর্মীদের যতটুকু সম্ভব পুনর্বাসন চলছে। দল পুনর্গঠনের কাজও কিছু কিছু হচ্ছে।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, ডাকসু নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতৃত্ব বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে দল ও জোটের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে গণফোরামের নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর জাতীয় সংসদে ​যোগ দেওয়ায়। বিএনপির নেতাদের অনেকে মনে করেন, ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়া সুলতান মনসুর সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই শপথ ​গ্রহণ এবং সংসদে যোগ দিয়েছেন। এর ফলে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের সাংসদেরা শেষ মুহূর্তে হলেও শপথ ​নিতে পারেন বলে যে বলাবলি হচ্ছিল, তা জটিল হয়ে গেছে।

অবশ্য বিএনপির মহাসচিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুলতান মনসুরের ঘটনায় আমরা বিব্রত নই। আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি।’ তিনি বলেন, ঐক্যফ্রন্টের নেতারা সবাই একমত যে সুলতান মনসুর গর্হিত কাজ করেছেন। এ জন্য তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

এর আগে গত মাসে জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর অভ্যন্তরীণ সংকটের রেশও পড়ে​ বিএনপির ওপর। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থানের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং দলে সংস্কার প্রশ্নে জামায়াতের ভেতরেই দুটি পক্ষ তৈরি হয়। এর জেরে দলটির প্রভাবশালী নেতা আবদুর রাজ্জাক পদত্যাগ করার পর বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আসে। এরপর জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের জন্য বিএনপির ওপর চাপ বাড়ে দলের শুভাকাঙ্ক্ষীদের দিক থেকে, যা এখনো আছে।

এর আগে জামায়াত নিজে থেকে ২০-দলীয় জোট থেকে সরে যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বলে দলটির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। তারা এ সিদ্ধান্তের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না করার কৌশল নিয়েছে। জামায়াতের এই সিদ্ধান্তও বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলেছে।

এর আগে গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটা অংশ দলের নির্বাচনকালীন নেতৃত্ব নিয়ে কথা তোলে। এ নিয়ে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার মধ্যে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়। সর্বশেষ জানা গেছে, সম্প্রতি দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই দূরত্ব কিছুটা কমেছে।

জেলা নেতাদের মত নিচ্ছেন তারেক

বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জেলা নেতাদের মতামত নেওয়া শুরু করেছেন। ঠাকুরগাঁও ও বান্দরবান জেলা দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার বরিশাল উত্তর ও দক্ষিণ জেলার নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় হয়।

৮১ সাংগঠনিক জেলার মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ১​৮ সাংগঠনিক জেলার নেতাদের সঙ্গে স্কাইপেতে মতামত নিয়েছেন তারেক রহমান। তিনি বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা, সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের প্রকৃত চিত্র, ভবিষ্যতে দলের করণীয় কী হতে পারে তা জানতে চেয়েছেন। পাশাপাশি জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকা না-থাকার বিষয়েও জেলার নেতাদের কাছে মতামত চেয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

এ ছাড়া বিএনপির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে সম্প্রতি জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবী দল ও কৃষক দলের নতুন আহ্বায়ক কমিটি এবং পেশাজীবীদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) ও অ্যাগ্রিকালচারিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (অ্যাব) নতুন কমিটি হয়েছে। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বিএনপির বিদেশবিষয়ক উপকমিটি পুনর্গঠন করা হয়। যদিও এসব কমিটি গঠনের বিষয়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকে জানতেন না বলে জানা গেছে।

খালেদার মুক্তি আন্দোলন নিয়ে দ্বিধা

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো জানায়, এ মুহূর্তে তাদের মাথাব্যথা দলীয় প্রধান কারাবন্দী খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তাঁর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা। তবে তা কী উপায়ে, আন্দোলন না সমঝোতা—তা নিয়ে নীতিনির্ধারকেরা দ্বিধায় আছেন। জ্যেষ্ঠ নেতারা আন্দোলন ছাড়া খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে না বললেও কোনো কর্মপরিকল্পনা নিতে পারেনি বিএনপি।

দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপির নীতিনির্ধারকদের অনেকে দ্রুত খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন জোরদার করতে কর্মসূচি দেওয়ার পক্ষে। তাঁরা চান, বিএনপির পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও মুক্তির আন্দোলনে সক্রিয় হোক। তবে আন্দোলনে নেমে মুক্তি আদায় সম্ভব কি না, তা নিয়ে নেতাদের অনেকে সন্দিহান। উপরন্তু নতুন করে নেতা-কর্মীদের হামলা-মামলার শিকার হওয়ার আশঙ্কা আছে। দল পুনর্গঠনের আগে আবার এমন পরিস্থিতিতে পড়তে চান না অনেকে।

বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের কৌশল নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতৃত্বেও কিছুটা দ্বিধা আছে। তাঁরা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। ভোটের আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে প্রহসনের নির্বাচন করা হয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট এই ইস্যু ধরে রাখতে চায়। তবে জাতীয় সংসদের পুনর্নির্বাচনসহ প্রাসঙ্গিক অন্যান্য দাবির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা এবং তাঁর মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে আপত্তি নেই ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের।

তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ মনে করেন, দেশের অবরুদ্ধ গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে হলে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ক্ষতিগ্রস্ত নেতা-কর্মীদের পুনর্বাসন করা। নেতা-কর্মীদের অনেকে জেলে, অনেকে মামলার কারণে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, ভোটের আগে হামলায় বহু কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত। আগে তাঁদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।

দলীয় সূত্র জানায়, ভোটের আগে সারা দেশে হামলা-মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত নেতা-কর্মীর পাশে দাঁড়াতে ও আইনি সহায়তা দিতে গত নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ সেটা মানছেন।

একাদশ সংসদ নির্বাচনোত্তর বিএনপির রাজনীতির মূল্যায়ন জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, দলটির চেয়ারপারসন জেলে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্বাসিত। তাই দলের নেতা-কর্মীদের পুনর্বাসন বা দল পুনর্গঠনের ব্যাপারে যত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল, সেটা হচ্ছে না। এত বড় বিপর্যয়ের পর উঠে দাঁড়াতে একটু সময় লাগবে। তাঁর মতে, জামায়াত ও সুলতান মনসুরের ঘটনা বিএনপির জন্য ‘উটকো ঝামেলা’।