বিলোনিয়ার প্রথম যুদ্ধ

স্বাধীনতাযুদ্ধের অনেক ইতিহাস এখনো অজানা। একাত্তরে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের নিজেদের কলমে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের দুঃসাহসী অভিযানগুলো। এসব লেখা নিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে দ্রুতই প্রকাশিত হবে মুক্তির লড়াই: মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখযোদ্ধাদের কলমে একাত্তরের গৌরবময় যুদ্ধগাথা শিরোনামে একটি গ্রন্থ। প্রকাশিতব্য এ গ্রন্থ থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু যুদ্ধের স্মৃতির চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো। আজ প্রকাশিত হলো বিলোনিয়া যুদ্ধের কথা:

মেজর জেনারেল ইমাম-উজ জামান, বীর বিক্রম
মেজর জেনারেল ইমাম-উজ জামান, বীর বিক্রম

বিলোনিয়া ফেনী জেলার (১৯৭১ সালে নোয়াখালী জেলার মহকুমা) দুটি থানা পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া নিয়ে গঠিত। বিলোনিয়াকে শত্রুমুক্ত করার জন্য একটি মিশ্র বাহিনী দিয়ে বিলোনিয়ার দক্ষিণাংশ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর ১ নম্বর সেক্টরের নিয়মিত ও স্বল্পপ্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ব দিক থেকে এবং ২ নম্বর সেক্টরের নিয়মিত ও স্বল্পপ্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চিম দিক থেকে বিলোনিয়ার দক্ষিণ মুখে প্রবেশ করার আদেশ দেওয়া হয়। এই দুটি সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা আগে থেকেই তাঁদের অবস্থানের আশপাশের এলাকাগুলোতে অপারেশন চালিয়ে আসছিলেন। পরিকল্পনা মোতাবেক ১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরের ১ জুন নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তিনটি কোম্পানির সমন্বয়ে মেজর জিয়াউর রহমানের (বীর উত্তম, পরে লে. জেনারেল ও রাষ্ট্রপতি) নেতৃত্বে বিলোনিয়ার পূর্ব সীমান্তে চাঁদগাজীর সামান্য দক্ষিণ দিক দিয়ে বিলোনিয়াতে প্রবেশ করেন এবং আগের আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে মুহুরী নদী পর্যন্ত প্রসারিতভাবে দক্ষিণ দিকে মুখ করে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। মুহুরী নদীর সংলগ্নে অবস্থান নেওয়া কোম্পানিটির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন অলি আহমদ (বীর বিক্রম, পরে কর্নেল), মাঝের কোম্পানিটির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহফুজুর রহমান (বীর বিক্রম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং জিয়া হত্যার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত) এবং সীমান্তসংলগ্ন কোম্পানিটির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (পরে মেজর)।
মেজর জিয়া চাঁদগাজীর নিকটবর্তী স্থানে সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপন করেন। একই সময়ে ২ নম্বর সেক্টরের মক্তিযোদ্ধারাও চারটি কোম্পানিতে বিভক্ত হয়ে পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে নোয়াপুর-জাম্মুরা হয়ে বিলোনিয়াতে প্রবেশ করেন এবং পশ্চিমের আন্তর্জাতিক সীমানা হতে মুহুরী নদী পর্যন্ত দক্ষিণমুখী হয়ে তিন কোম্পানিকে সম্মুখে এবং এক কোম্পানিকে পেছনে রেখে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। আমার নেতৃত্বে ছিল মুহুরী নদীর সংলগ্ন সাধারণ এলাকা পূর্ব রশিকপুরে অবস্থানরত কোম্পানিটি। মাঝের কোম্পানিটির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম (বীর বিক্রম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল), পশ্চিম দিকে আন্তর্জাতিক সীমান্তসংলগ্ন সাধারণ এলাকা জাম্মুরাতে অবস্থান নেওয়া কোম্পানিটির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন গাফফার হালদার (বীর উত্তম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) এবং পেছনের কোম্পানিটির নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম চৌধুরী (পরে মেজর)। মর্টার প্লাটুন পেছনের কোম্পানির নিকটবর্তী স্থানে রাখা হয়। ২ নম্বর সেক্টরের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন মেজর এ জে এম আমিনুল হক (বীর উত্তম, পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল)।
১৯৭১ সালের ৩ জুনের মধ্যে ১ ও ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা বিলোনিয়া অবস্থানের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। পরদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিলোনিয়ার সর্বশেষ ঘটনাবলি সম্পর্কে অবহিত হয় এবং বন্দুয়া-দৌলতপুর রেললাইন ও ছাগলনাইয়া থেকে উত্তর দিকে চলে যাওয়া রাস্তা বরাবর দুটি অক্ষে অগ্রসর হয়ে এক আকস্মিক আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। পাকিস্তানি বাহিনী অগ্রসর হওয়ার সময় ভেবেছিল যে তাদের সামনে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কিছু অপ্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারে। যার জন্য তারা মানসিকভাবে খুব বেশি সতর্ক ছিল না। এই অসতর্কতার কারণেই তারা মুক্তিবাহিনীর ভারী মেশিনগান এবং প্রতিরক্ষায় অবস্থিত অন্যান্য অস্ত্রের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে আসা অবিরত গোলাগুলির কবলে পড়ে ৬০ ও ৭০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হন। এতে শত্রুরা সহজেই বুঝতে পারে যে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানটি দুর্বল নয়, বরং দুই ব্যাটালিয়ন নিয়মিত ও স্বল্পপ্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা-সংবলিত একটি সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা অবস্থান। শত্রুর অগ্রাভিযান অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় তারা পিছু হটে যায়। ১৯৭১ সালের ৭ জুন ভোরে উল্লিখিত দুটো অক্ষেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী অগ্রাভিযান পুনরায় শুরু করে। কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর তারা আবারও মুক্তিবাহিনীর গুলিবর্ষণের মুখে পড়ে এবং বাংলার দামাল সন্তানেরা পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ সফলতার সঙ্গে প্রতিহত করেন। এই অগ্রাভিযানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৫০ থেকে ৬০ জন সেনা নিহত হন। ৯ জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীও তাদের রণকৌশলে কিছুটা পরিবর্তন এনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষার সমগ্র সম্মুখভাগজুড়ে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করে। পাকিস্তানি এক ব্যাটালিয়নেরও বেশি সেনার এই প্রচেষ্টা সারা দিন ধরে চলে এবং ফেনী ও ছাগলনাইয়ার মধ্যবর্তী কোনো স্থানে অবস্থিত গোলন্দাজ বাহিনীর এক রেজিমেন্ট তাদের সাহায্যে নিয়োজিত ছিল। শত্রুর এ প্রচেষ্টাও মুক্তিবাহিনী ব্যর্থ করে দেয়। ইতিমধ্যে প্রতিরক্ষায় অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী অনুভব করে যে প্রতিরক্ষা অবস্থানটি আরও শক্তিশালী করার জন্য এর সম্মুখভাগে কিছু মাইন বসানো প্রয়োজন। কাজেই একটি মাইন বেষ্টনী তৈরি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এম-১৬ মাইন সংগ্রহ করা হয় এবং প্রতিরক্ষা অবস্থানের সমগ্র সম্মুখভাগজুড়ে তিন-চার দিন সময় নিয়ে মাইন স্থাপন করা হয়। ১১ জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনী পুনরায় মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায় এবং মুক্তিবাহিনী এককভাবে শত্রুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করে দেয়। এভাবে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর ১১ বার নিষ্ফল আক্রমণ চালায়। তারা দিন-রাত মুক্তিবাহিনীর অবস্থানগুলোর ওপর অবিরাম গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখে। পরিশেষে শত্রুরা বুঝতে পারে যে এভাবে আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান ধ্বংস করা সম্ভব নয়।