বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থানে পরদেশিজন

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক মনোরঞ্জন রায় চৌধুরীর নাতি-নাতনিরা কলকাতা থেকে এসেছেন বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে তাঁরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ও নীরবতা পালন করেন। গতকাল গোপালগঞ্জের সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে।  ছবি: আশরাফুল আলম
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক মনোরঞ্জন রায় চৌধুরীর নাতি-নাতনিরা কলকাতা থেকে এসেছেন বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে তাঁরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ও নীরবতা পালন করেন। গতকাল গোপালগঞ্জের সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে। ছবি: আশরাফুল আলম

‘১৯৪১ সালে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেব। পরীক্ষায় পাস আমি নিশ্চয়ই করব, সন্দেহ ছিল না। রসরঞ্জন বাবু ইংরেজির শিক্ষক, আমাকে ইংরেজি পড়াতেন। আর মনোরঞ্জন বাবু অঙ্কের শিক্ষক, আমাকে অঙ্ক করাতেন। অঙ্ককে আমার ভয় ছিল। কারণ ভুল করে ফেলতাম।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। তিনি পড়তেন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে। মধুমতী নদীর পাড়েই এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এখন সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ।

অঙ্কে বঙ্গবন্ধু ভালোভাবেই বৈতরণি পেরিয়ে গিয়েছিলেন শিক্ষক মনোরঞ্জন রায় চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে। মনোরঞ্জনবাবুরা গোপালগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে উলপুরের জমিদার। অনেক বড় পরিবার। মনোরঞ্জন রায় ছিলেন তিন আনি অংশে। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। দেশভাগের আগেই পরিবার নিয়ে কলকাতা চলে যান। তারপর কয়েক যুগ পেরিয়ে গেছে। মনোরঞ্জনবাবুর সেই অঙ্কে ভিতু ছাত্রটি কালক্রমে পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশের মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করে পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত হয়ে বাঙালি অর্জন করেছে চিরকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।

আজ রোববার জাতি উদ্‌যাপন করবে তাঁর ৯৯তম জন্মবার্ষিকী। আর এই দিন সামনে রেখেই গতকাল শনিবার সেই স্মৃতিময় বিদ্যাপীঠে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বিনম৶ শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে শিকড়ের সন্ধানে আসা মনোরঞ্জন রায় চৌধুরীর নাতি-নাতনি ও পরিবারের সদস্যরা।

মনোরঞ্জনবাবুর এই নাতি-নাতনিরাও কর্মজীবন থেকে অবসরে চলে গেছেন। তাঁর নাতি-নাতনিদের পরিবারের ১২ জনের দল বেরিয়ে পড়েছে শিকড়ের সন্ধানে—যদি দুই পুরুষ আগের ফেলে যাওয়া বসতভিটার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়।

গোপালগঞ্জে, উলপুরে বিধ্বস্ত দলান, শ্যাওলা ধরা ইট-সুরকিতে, সোঁদা মাটিতে তাঁরা খুঁজলেন নিজের শিকড়। এই শিকড়সন্ধানী যাত্রা শুরু করেছিলেন তাঁরা ১০ মার্চ। কলকাতার দমদম বিমানবন্দর থেকে সোজা চট্টগ্রাম বিমানবন্দর। মনোরঞ্জনবাবুর নাতবউ কাকলি চক্রবর্তী জানালেন, তাঁদের সাত দিনের প্যাকেজ। সব বন্দোবস্ত করেছিল একটি বেসরকারি ট্যুর অপারেটর। পরিকল্পনা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের, সেই সঙ্গে নিজেদের পূর্বপুরুষের ভিটার সন্ধান করা আর বাংলাদেশের বিখ্যাত সমুদ্রসৈকত, পার্বত্য এলাকা ঘুরে দেখা।

পাহাড়-সমুদ্র দর্শন শেষে শিকড়সন্ধানীরা ঢাকায় আসেন বুধবার রাতে। বৃহস্পতিবার তাঁরা ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে দেখেছেন। তাঁদের কাছে বড় মর্মস্পর্শী ছিল সেই অভিজ্ঞতা। অঞ্জনা মালিক বলছিলেন, গুলির দাগ লেগে থাকা দেয়াল-দরজা, বঙ্গবন্ধু যে সিঁড়িতে পড়ে ছিলেন এসব দেখে তাঁর কান্না পেয়ে গিয়েছিল। তাঁরা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের কথা জানতেন, কিন্তু তা যে এমন নারকীয় হয়ে উঠেছিল, চাক্ষুষ দেখার আগে তা ভাবতেও পারেননি।

গোপালগঞ্জে আসার পথে শুক্রবার তাঁরা সাভারে নামলেন জাতীয় স্মৃতিসৌধে। তার আগে এক ফাঁকে ঢাকেশ্বরী মন্দির আর ঢাকায় বেঙ্গল বইতে। সন্ধ্যায় একটু আলাপচারিতা জমেছিল জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, পারিবারিক বন্ধু কবি ও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরীর সঙ্গে।

শুক্রবার ফরিদপুরে এসে তাঁরা ঘুরে এলেন পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের বাড়ি। রাজবাড়ীতে সন্তোষ কুমার ঘোষ যে স্কুলে পড়েছেন, সেই স্কুলটি দেখে এলেন সন্ধ্যায়।

কাল শনিবার সাতসকালে যাত্রা শুরু হলো সেই বহুপ্রতীক্ষিত গোপালগঞ্জের পথে। উলপুরে রায় চৌধুরীদের জমিদারবাড়ির কিছু ভাঙা দালান কোনোমতে টিকে আছে। তাদের প্রতিষ্ঠা করা উলপুর পূর্ণচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়টির পুরোনো ভবনটি এখনো আছে। জীর্ণ ঘরবাড়িতে নানাজন বসত করছে। এখানে কয়েক ঘর জ্ঞাতিকেও তাঁরা পেলেন। তাঁদের মধ্য একজন মৃণালকান্তি রায় চৌধুরী ঘুরে ঘুরে দেখালেন রায় চৌধুরীদের ভেঙে পড়া বিবর্ণ বাড়ির অবশেষ, পুকুরঘাট, মন্দির। সেখানে তাঁরা শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন, কেউ কেউ পূর্বপুরুষের ভিটার একমুঠো মাটি তুলে নিলেন পরম মমতায়, সঙ্গে নিয়ে যাবেন বলে।

খুবই আবেগাপ্লুত ছিলেন তাঁরা। কলকাতা থেকে আসা দলটির সদস্য কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তী বললেন, ‘এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কলকাতার ইট–কাঠের ভেতর থেকে যেন এক রূপকথার ভেতরে এসে পড়েছি। এই গ্রামের কথা আমরা অনেক শুনেছি মা–ঠাকুদারদের কাছে। কিন্তু মনে হতো কোথাও যেন একটা শূন্যতা রয়ে গেছে। এখানে এসে যেন সেই শূন্যস্থান পূর্ণ হলো।’

তবে একটা আফসোস তাঁদের থেকে গেল, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে যেতে পারলেন না নিরাপত্তার কারণে। সেই ঘাটতি অবশ্য পূরণ হলো গোপালগঞ্জ শহরে বঙ্গবন্ধু আর মনোরঞ্জনবাবুর স্মৃতিজড়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে এসে। বঙ্গবন্ধু

কলেজের সামনে বঙ্গবন্ধুর প্রমাণ আকারের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। সেখানেই তাঁরা পুষ্পস্তবক অর্পণ করলেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করে কিছু সময় নীরব হয়ে রইলেন।