কার্যকর ভিত তৈরিতে চাই সংস্কার

তোফায়েল আহমেদ
তোফায়েল আহমেদ

স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে যেভাবে কার্যকর করা দরকার, বাংলাদেশ সে পথে যায়নি। সামরিক শাসনের অধীন রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার কাঠামোর অধীনে ‘কেন্দ্রীয় সরকারের অধস্তন এজেন্সি’ হিসেবে স্থানীয় সরকার গঠন ও পরিচালনার ঐতিহ্য এ দেশে আইয়ুব আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে যে সংবিধান রচিত হয়, তাতে সে কাঠামো থেকে বের হয়ে নতুন জনবান্ধব কাঠামোর একটি রূপরেখা দেওয়া হয়। সে রূপরেখা অনুযায়ী প্রতিটি প্রশাসনিক একককে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ওপর ‘প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে’ মর্মে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা আছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির অধীনে ‘প্রশাসন এবং সরকারি কর্মচারীদের কার্যাবলি, জনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনসেবা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে রাষ্ট্র তা না করলে কী হবে, সেরকম প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা সংবিধানে রাখা হয়নি। সংবিধান এ–সংক্রান্ত সব অধিকার জাতীয় সংসদের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। সংবিধানের এ–সংক্রান্ত ধারার প্রথম শব্দ ‘আইনানুযায়ী’ অর্থাৎ সংসদ যেভাবে আইন প্রণয়ন করবে, সেভাবেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে। সংসদ এখন তাই তার বিবেচনামতো ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থায় ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ নির্বাচনের বিধান করেছে এবং তা কার্যকর হচ্ছে।

দেশে একীভূত কাঠামোতে স্থানীয় সরকারের কোনো কাঠামো প্রতিষ্ঠিত নয়। এক একটি প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাঠামো এক এক রকম। ফলে আন্তপ্রতিষ্ঠান সম্পর্ক কাজ করে না। কোন স্তরের প্রতিষ্ঠান কী কাজ করবে, তার নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। সকল স্তরের জন্য দীর্ঘ একটি কার্যতালিকা আছে। সে কাজ সম্পন্নের জন্য কারও কাছেই প্রয়োজনীয় অর্থ-জনবল নেই। অপরদিকে মাঠ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছেই জনবল ও অর্থ। এ ধরনের পরস্পরবিরোধী আইনের বেড়াজালে স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় মাঠ প্রশাসন উভয়েই বন্দী।

এখন পুরোনো সরকার (আওয়ামী লীগ) নতুনভাবে ক্ষমতাসীন, যদি তারা সত্যিকার অর্থে একটি টেকসই সংস্কার করা স্থানীয় সরকারব্যবস্থা চায়, তাহলে শুরুতে যে কাজটি করতে পারে তা হচ্ছে একটি শক্তিশালী কমিটি বা কমিশন করে দেশের স্থানীয় সরকার ও মাঠ প্রশাসনব্যবস্থার একটি বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন এবং করণীয় সম্পর্কে একটি দিকনির্দেশনা গ্রহণ। ভারত ‘বলবন্ত রায় কমিটি’, ‘অশোক মেহতা কমিটি’সহ অসংখ্য কমিটির মতামত নিয়ে সংস্কারগুলো করেছে।

বর্তমানে আমাদের দেশে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্থরে প্রায় নয়টি মৌলিক আইন, দুই শতাধিক অধস্তন আইন বা রেগুলেশন, হাজার হাজার সার্কুলার রয়েছে। ফলে কাজকর্মে ঘোরতর বিশৃঙ্খলা। মন্ত্রণালয় ও সরকারি কর্মকর্তারাও অনেক সময় অনেক কিছুর সময়মতো সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ প্রয়োজন। একীভূত একটি একক আইনে সব স্থানীয় প্রতিষ্ঠান চলতে পারে। আইন ও সার্কুলারের জঙ্গল থেকে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে মুক্তি দিতে হলে একটি কমিটির মাধ্যমে এসব আইনের পর্যালোচনা প্রয়োজন। অনুরূপভাবে অর্থায়ন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে দেশের সিটি করপোরেশন থেকে ইউনিয়ন পরিষদ––সবাইকে জাতীয় উন্নয়ন বাজেট থেকে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা মোট উন্নয়ন বাজেটের ১ শতাংশেরও কম। এ রকম বরাদ্দের যৌক্তিকতা কী? তাহলে এত অর্থ-শ্রম-সময় দিয়ে এসব নির্বাচন করার কী মানে? সংবিধানের নির্দেশনারই বা কী অর্থ? একটি সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। পাঁচ বছর ধরেই স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হতে থাকে। নির্বাচন মানে অস্থিরতা, প্রশাসনসহ অনেকের দীর্ঘস্থায়ী ব্যস্ততা—আরও অনেক কিছু।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশে একটি একক তফসিলে এক দিনেই এসব নির্বাচন হয়ে থাকে। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে, অনেকে তার বিরোধিতা করছেন। সংগত কারণেই করছেন। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে পারেন, তাহলে তা করতে হবে কাউন্সিলর বা সদস্য নির্বাচন। দ্বিতীয় পর্যায়ে তাঁরাই তখন চেয়ারম্যান বা মেয়র নির্বাচন করবেন। দেশে পুরোনো স্থানীয় সরকার পদ্ধতির বদলে সংসদীয় পদ্ধতির স্থানীয় সরকার হবে। এ জাতীয় বহু সংস্কার ভাবনা আকাশে–বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে। সত্যিকার অর্থে কার্যকর একটি স্থানীয় সরকারের ভিত স্থাপন করতে চাইলে এ সরকারই গুরুত্ব দিয়ে একটি সংস্কার উদ্যোগ নিতে পারে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ