তুরাগের পাশে ২৬ শতাংশ ভরাট

তুরাগ নদের আশপাশে ২৬ শতাংশ জলাভূমি গত ১৬ বছরে ভরাট হয়ে গেছে। ভরাটের প্রক্রিয়া এখনো চলছে। নগরবিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, এভাবে তুরাগ ভরাট হতে থাকলে একসময় তীব্র পানিসংকটে পড়বে ঢাকা। নদ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
ভরাটের এই শঙ্কাজনক চিত্র উঠে এসেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায়। ঢাকার প্রক্রিয়াধীন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রণয়নের অংশ হিসেবে সমীক্ষাটি করা হয়েছে।
সমীক্ষায় আশুলিয়া থেকে আমিনবাজার—তুরাগ নদের এই অংশের দুই তীরের প্রায় ৯ হাজার ১১৬ দশমিক ৬৪ একর এলাকা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০০২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই জলাভূমির ২ হাজার ৪০৩ দশমিক ৩৪ একর ভরাট করা হয়েছে। স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে করা এই সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা বলছেন, ভরাট করা জায়গায় এখন স্থায়ী-অস্থায়ী নানা স্থাপনা গড়া হয়েছে।
এভাবে নদীতীরের জলাভূমি ভরাট করা আইনে নিষিদ্ধ। ২০০০ সালে করা আইনটি ‘প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন’ নামে পরিচিত। এই আইন অনুযায়ী, মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত বা চিহ্নিত নদী, খাল, বিল, দিঘি, ঝরনা বা জলাশয়, বন্যাপ্রবাহ এলাকা এবং বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোনো ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। অর্থাৎ সেটি ভরাট করা যাবে না। আইন অনুযায়ী এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, তুরাগ নদের পুরো অংশই রাজউকের আওতাধীন এলাকায় পড়ে। রাজউকের চলমান ড্যাপে নদীর দুই পাশের অংশ বন্যাপ্রবাহ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। সংস্থাটির অনুমোদন ছাড়াই অবৈধভাবে তুরাগ নদের ওই অংশ (আশুলিয়া থেকে আমিনবাজার) ভরাট করা হয়েছে।
আইন থাকা সত্ত্বেও কেন এমন অবৈধ ভরাট বন্ধ করা গেল না, জানতে চাইলে রাজউকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজউকের জনবল, রাজনৈতিক প্রভাব, সদিচ্ছা নানা বিষয় এর সঙ্গে জড়িত আছে। তাঁর মতে, তুরাগের মতোই ঢাকা মহানগরের অন্যান্য অংশেও জলাভূমি ভরাটের চিত্র প্রায় একই রকম। এই কর্মকর্তা বলেন, শুধু আইনই জলাধার রক্ষায় যথেষ্ট নয়। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, রাজধানীতে আবাসন খাতের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ কারণে অবৈধ ভরাট নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
তবে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আইন থাকার পরও জলাভূমি রক্ষায় ব্যর্থ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে দায় নিতে হবে। ভরাট হওয়া জলাভূমিগুলো রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগের পাশাপাশি আইন যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। কেউ ব্যর্থ হলে সে দায় নিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, তুরাগ ও রাজধানীর অন্যান্য অংশের জলাভূমি ভরাট হয়ে গেলে ঢাকার পানির স্তর অনেক নেমে যাবে। এতে পানির সংকট দেখা দেবে। তাই যেকোনো উপায়ে এগুলো রক্ষা করতে হবে।
রাজউকের ওই সমীক্ষা অনুযায়ী, আশুলিয়া-আমিনবাজার এলাকায় সবচেয়ে বেশি জলাভূমি ভরাট হয়েছে গত বছর। শুধু সে বছরই ভরাট করা হয়েছে ৭৩৮ দশমিক ৩৯ একর জলাভূমি। এভাবে নদের পার্শ্ববর্তী এলাকা ভরাট হওয়ার মাধ্যমে মূল নদেও বালু জমে ভরাট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে বলে উল্লেখ করেছেন সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের উপনির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খান। তিনি বলেন, এভাবে ভরাট হলে নদীকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যাবে। পাশাপাশি নদীর ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় অতিবৃষ্টিতে ও বন্যায় পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হবে।
তুরাগের অংশসহ চলমান ড্যাপে জলাভূমি হিসেবে চিহ্নিত এলাকা ছিল ১ লাখ ৯৩৭ একর। এর মধ্যে ৭-৮ শতাংশ জায়গা গত ৯ বছরে ভরাট হয়েছে বলে রাজউকের সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।
এগুলো রক্ষায় রাজউক আইন অনুযায়ী কী ব্যবস্থা নিয়েছে, জানতে চাইলে সংস্থাটির নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রক্রিয়াধীন ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ভরাট বন্ধে জলাধার আইনে মামলা, থানায় সাধারণ ডায়েরিসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তারপরও সব জলাভূমি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য প্রক্রিয়াধীন ড্যাপে নীতিগত কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, যাতে যেকোনো মূল্যে জলাভূমি রক্ষা করা যায়। তিনি বলেন, ঢাকাকে বাঁচাতে হলে অধিগ্রহণ করে হলেও জলাভূমি রক্ষা করতে হবে। প্রক্রিয়াধীন ড্যাপে ‘ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইটস (টিডিআর)’ পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে জলাভূমির মালিককে বাজারমূল্য অনুযায়ী একটি সনদ দেওয়া হবে। এই সনদ তিনি সরকার বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে ক্ষতিপূরণ নিতে পারবেন। এই পদ্ধতি বিশ্বের অনেক দেশেই অনুসরণ করা হচ্ছে।