শত বছরেও স্বপ্ন পূরণ হয়নি নওগাঁবাসীর

উত্তরাঞ্চলের প্রসিদ্ধ রেলওয়ে জংশন সান্তাহার থেকে নওগাঁ হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর পর্যন্ত একটি রেলপথের দাবি নওগাঁবাসীর দীর্ঘদিনের। রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকেও এ বিষয়ে কম প্রতিশ্রুতি মেলেনি। কিন্তু নওগাঁবাসীর এই দাবি বাস্তবায়নে কোনো সরকার কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি।

অবশ্য এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জল হোসেন কিছুটা আশার বাণী শোনান। গত মঙ্গলবার মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সান্তাহার থেকে নওগাঁ হয়ে রহনপুর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ের মহাপরিকল্পনায় (মাস্টারপ্ল্যান) রয়েছে। তিনটি পর্যায়ে এটা বাস্তবায়িত হবে। তবে কবে নাগাদ এই রেললাইন নির্মাণ শুরু হতে পারে, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে পারেননি তিনি।

বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে ১৯১০ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। সেই জরিপ দলের নেতা ডেলগ্রিন সান্তাহার জংশন থেকে নওগাঁর ওপর দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর পর্যন্ত ৯৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের সুপারিশ করেন। সুপারিশের ভিত্তিতে তখন একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের পর থেকে উত্তরাঞ্চলের মানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার রেলওয়ে বোর্ড ১৯৬৩ সালে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে পুনরায় কাজ শুরু করে। তৎকালীন রেলওয়ে বোর্ড আরেকটি জরিপ চালায়। জরিপ দলের প্রধান আশরাফ আলী ডেলগ্রিনের প্রতিবেদনের পক্ষে মত দেন। তিনি ১৯৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে প্রকল্পের একটি নকশা (ব্লুপ্রিন্ট) ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের কাছে হস্তান্তর করেন। আশরাফ আলী জরিপ কমিটির প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী সান্তাহার রেলওয়ে জংশন থেকে নওগাঁ শহর, মহাদেবপুর উপজেলার মহিষবাথান বাজার, পত্নীতলা উপজেলার নজিপুর পৌরসভা, পোরশা উপজেলার সারাইগাছী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর পর্যন্ত ৯৯ কিলোমিটার রেলপথ হওয়ার কথা ছিল। পরবর্তীকালে প্রকল্পটি হাতে নিয়েও বন্ধ করে দেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার।

সান্তাহার-রহমনপুর রেলপথ নির্মাণে নওগাঁর মানুষের দাবি আবার জোরালো হচ্ছে। বর্তমানে নওগাঁ থেকে একজন পূর্ণমন্ত্রী (খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার) হওয়ায় স্থানীয় মানুষের প্রত্যাশা আরও বেড়ে গেছে। মন্ত্রী নিজেও নির্বাচনের আগে সান্তাহার-রহনপুর রেলপথ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

১৬ ফেব্রুয়ারি নওগাঁয় এক অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘আমি সংসদ অধিবেশনে এবং সরকারের ক্যাবিনেট মিটিংয়ে সান্তাহার নওগাঁ হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের দাবির কথা উত্থাপন করব। এই সরকারের আমলেই নওগাঁ রেললাইন স্থাপনে প্রকল্প গ্রহণ এবং সেটি বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখব। পাশাপাশি নওগাঁর অন্য পাঁচ সাংসদকেও এ ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া এবং উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাতে চাই।’

স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁ। সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে নওগাঁর বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। সংগঠনটির সভাপতি ডি এম আবদুল বারী বলেন, উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে নওগাঁ একটি অনগ্রসর জেলা। যোগাযোগের ক্ষেত্রে সড়কপথ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এই জেলায় রেলপথের গুরুত্ব অপরিসীম। এই এলাকায় একটি রেলপথ হলে সেটি যাত্রীর পাশাপাশি উৎপাদিত কৃষিপণ্য পরিবহনে প্রধান ভূমিকা রাখতে পারবে।

নওগাঁর ইতিহাস গবেষক ও কবি আতাউল হক সিদ্দিকী বলেন, এই রেলযোগাযোগ স্থাপনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ সময়ে জনগণের দাবি থাকলেও শুধু নেতৃত্বের অভাবে এবং তাঁদের দুর্বলতার কারণে সান্তাহার থেকে নওগাঁর মধ্য দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর পর্যন্ত রেলযোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। রেলপথ হলে এই দুই জেলার ধান, আমসহ উৎপাদিত কৃষিপণ্য স্বল্পমূল্যে ও দ্রুত পরিবহন অনেক সহজ হয়ে যেত।

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান বলেন, ‘সড়কপথ ছাড়া নওগাঁর সঙ্গে অন্য কোনো জেলার সংযোগ নেই। এ জন্য এ জেলাকে “পকেট ডিস্ট্রিক্ট” বলা যায়। নওগাঁয় রেললাইন স্থাপনের জন্য প্রশাসনিকভাবে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাব। এই রেললাইন যাতে দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয়, এ ব্যাপারে আগামী জেলা প্রশাসক সম্মেলনেও বিষয়টি আমি গুরুত্ব সহকারে উত্থাপন করব।’