যে মায়ের সন্তানেরা হবে হৃষ্টপুষ্ট

৩৫ বছর বয়সী ছমিরন বেগমের আট সন্তান। সিলেটের বালাগঞ্জের আদিত্যপুর গ্রামের এ মায়ের ১৯ মাস বয়সী সন্তান তীব্র অপুষ্টির শিকার। হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার পর তার ওজন এবং বাহুর মধ্যভাগের পরিধি বেড়েছে। ছমিরন জানান, এই সন্তান জন্ম নিয়েছিল অনেক ছোট এবং একেবারেই কম ওজন নিয়ে। অন্য সাত সন্তানের বেলাতেও একই পরিস্থিতি ছিল। তবে এবারের পার্থক্য হলো সন্তানের তীব্র অপুষ্টি থাকলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, তা আগে জানা ছিল না।

১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয় রেহানা বেগমের। তাঁর তিন সন্তান। ছোট মেয়ের বয়স এক বছরের একটু বেশি। আগের দুই সন্তানের ওজন, উচ্চতা কিছুই মাপা হয়নি। তবে ছোটটির বেলায় আর সে ভুল হয়নি। সন্তান পেটে আসার পর থেকেই নিয়ম মানা শুরু করেন। মেয়ের জন্মের পর থেকে বেড়ে ওঠার মাপ রাখছেন, নিয়ম মানছেন।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে খামারের মালিক অপর্ণা রানী নাথ। তাঁর কাজে সহায়তা করছেন স্বামী ক্ষীতেশ দেবনাথ। ছবি: মানসুরা হোসাইন
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে খামারের মালিক অপর্ণা রানী নাথ। তাঁর কাজে সহায়তা করছেন স্বামী ক্ষীতেশ দেবনাথ। ছবি: মানসুরা হোসাইন

একই গ্রামের এ দুই চিত্র। ছমিরন ও রেহানা সচেতন হয়েছেন। তাই সন্তানদের পুষ্টির বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের নেতৃত্বে পরিচালিত সূচনা নামের একটি প্রকল্পের কর্মকর্তারা তা–ই বললেন। অপুষ্ট মা থেকে অপুষ্ট সন্তান জন্ম দেওয়ার যে দুষ্টচক্র, তা ভাঙতেই এই প্রকল্প।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সেভ দ্য চিলড্রেন বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ২০টি উপজেলায় ২ লাখ ২০ হাজার দরিদ্র পরিবারের শুধু বর্তমান মা নন, হবু মা, অর্থাৎ কিশোরী এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী প্রজননক্ষম নারীদের কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছে।

সিলেটের বালাগঞ্জের হাসিমুখে মা রেহানা ও তাঁর মেয়ে। ছবি: আনিস মাহমুদ
সিলেটের বালাগঞ্জের হাসিমুখে মা রেহানা ও তাঁর মেয়ে। ছবি: আনিস মাহমুদ

১২ ও ১৩ মার্চ সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে সূচনা প্রকল্পের আওতায় আসা মা ও হবু মায়েদের সঙ্গে কথা হয়। যে মায়েরা পুষ্টিসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য জানার সুযোগ পাননি, তাঁরা আফসোস করছেন। অনেকেই বলছেন, তথ্য জানা থাকলেও তেমন গুরুত্ব দিতেন না। এখন গুরুত্ব দিচ্ছেন, কারণ শুধু মুখে বললেই তো হবে না। সন্তানকে মাছ, মাংস, ডিম খাওয়ানোর সামর্থ্য তো থাকতে হবে। এখন নিজের গাছের সবজি, পুকুরের মাছ, ঘরের মুরগি বা হাঁসের মাংস খাওয়াচ্ছেন। ঘরে হাঁস-মুরগি না থাকলে কিনে এনে খাওয়াচ্ছেন।

কমলগঞ্জ উপজেলার পালিতকনা গ্রামের অর্পণা রানী নাথ গ্রামের আদর্শ খামারের মালিক। তিনি এখন অন্য নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। ৫০ শতক জমি লিজ নিয়েই চলছে এ চাষাবাদ। অপর্ণা বলছিলেন, বস্তায় চাষ, টাওয়ার গার্ডেনসহ বিভিন্ন চাষপদ্ধতির বিষয়ে আগে জানা ছিল না। এখন ফলন বেশি হচ্ছে। আর প্রকল্পের কর্তাব্যক্তিরা যে জ্ঞান শিখিয়ে দিয়েছেন, তা তো আজীবন সঙ্গেই থাকবে। এখন গ্রামের যে নারী বা পরিবার প্রকল্পের আওতাভুক্ত নয়, তারাও এসে শিখে যাচ্ছে নানা পদ্ধতি।

সরকারের হিসাব বলছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অপুষ্টি বিশেষ করে বয়স অনুযায়ী উচ্চতা কম বা খর্বকায় শিশু সিলেট বিভাগে সবচেয়ে বেশি, যা দেশের গড় হিসাবকেও ছাড়িয়ে গেছে। সর্বশেষ হিসাব বলছে, সিলেটে খর্বাকৃতি শিশুর হার ৪৯ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে, দেশে খর্বাকৃতি শিশুর গড় হলো ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। দাতা সংস্থা ডিএফআইডি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় ২০১৫ সাল থেকে শুরু হওয়া এ সূচনা প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ২০২২ সালের মধ্যে প্রকল্প এলাকায় অতিরিক্ত ৬ শতাংশ খর্বকায় শিশুর হার কমানো।

সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের উপকর্মসূচি পরিচালক মো. আলী রেজা জানালেন, সিলেটের ক্ষেত্রে ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য প্রকট। দম্পতিপ্রতি সন্তানসংখ্যা বেশি। সামাজিক কুসংস্কার, জমি চাষাবাদের অনুপযুক্তসহ নানা কারণে দরিদ্র পরিবারে পুষ্টি পরিস্থিতি নাজুক। এর সঙ্গে আছে পরিবার, বিশেষ করে পুষ্টি নিয়ে মায়েদের অজ্ঞতা।

সন্তানদের সঙ্গে মা রেহানা। ছবি: আনিস মাহমুদ
সন্তানদের সঙ্গে মা রেহানা। ছবি: আনিস মাহমুদ

বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেল, কোনো কোনো বাড়ি রাজপ্রাসাদের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এই বাড়ির মালিক যুক্তরাজ্য বা অন্য দেশে থাকেন। আবার অট্টালিকার পাশেই জীর্ণ ঘরে অনেক পরিবার মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় এক হাজার দিন, অর্থাৎ গর্ভের পুরো সময় এবং নবজাতক জন্মের পর দুই বছর পর্যন্ত সময়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সূচনা প্রকল্পে এই এক হাজার দিনকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) নিউট্রিশন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেসের জ্যেষ্ঠ পরিচালক তাহমিদ আহমেদ বলেন, জন্মের সময় যে শিশুর ওজন কম, তাদের খর্বাকৃতি হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। যে মায়ের পুষ্টির অভাব ও উচ্চতা কম, তাঁদের সন্তানের খর্বাকৃতি হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। মা বা হবু মায়েরা সচেতন হলে সুফল মিলবেই। সচেতন করার পাশাপাশি মায়েদের দারিদ্র্য থেকে টেনে বের করা, আয়ের উৎস ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমার রুমি মুরগি পালন করেন। ছবি: আনিস মাহমুদ
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার রুমি মুরগি পালন করেন। ছবি: আনিস মাহমুদ

সূচনা প্রকল্পের মূল্যায়ন জরিপ করছে আইসিডিডিআরবি। তাহমিদ আহমেদ বলেন, মূল্যায়ন জরিপে প্রকল্প এলাকায় পুষ্টি পরিস্থিতির কতটুকু উন্নয়ন হলো, তা জানা সম্ভব হবে।

কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল ইউনিয়নের রুজিনা ইয়াসমিনের তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট সন্তানের বয়স এক বছর। রুজিনা পুকুরে মাছ চাষ করছেন। এখন নিয়মিত মাছ খান, সন্তানদের খাওয়ান। মাছ বিক্রি করে মাংসসহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার কেনেন। মায়েদের দলে বসে এসব নিয়ে আলোচনাও করেন। গ্রামটিতে নারী দলের ৩৪ জন সদস্যের মধ্যে রুজিনাসহ চারজন মাছ চাষ করছেন। অন্যরা সবজি চাষ, মুরগি পালনসহ অন্যান্য কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

সিলেটের বালাগঞ্জে সন্তান কোলে মা ছমিরন। ছবি: আনিস মাহমুদ
সিলেটের বালাগঞ্জে সন্তান কোলে মা ছমিরন। ছবি: আনিস মাহমুদ

বিভিন্ন ইউনিয়নে ফাতেমা আক্তার, রোখসানা আক্তার, রুমি, তানজিনাসহ একাধিক কিশোরী এখন জানে, তারা পুষ্টিকর খাবার খেলে ভবিষ্যতে যে সন্তানের জন্ম দেবে, সে অপুষ্টির শিকার হবে না। এই কিশোরীরাও হাঁস-মুরগি পালনসহ বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বপ্ন দেখছে বাণিজ্যিকভাবে খামারি হওয়ার। এই কিশোরীরা অকপটেই জানিয়ে দিল, মাসিকের সময় তারা এখন নিজের টাকায় স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে ব্যবহার করছে। তানজিনা নিজের টাকায় বাড়িতে একটি ল্যাট্রিন দিয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের দেশীয় উপপরিচালক ইশতিয়াক মান্নান বলেন, শিশু, কিশোরী বা মায়ের পুষ্টির বিষয়টি অঙ্কের মতো। অঙ্ক ঠিক হতে হবে। জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত সন্তানকে শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এরপর বুকের দুধের পাশাপাশি যথাযথ ঘরের তৈরি পুষ্টিকর বাড়তি খাবার দিতে হবে। শুধু খাবার দিলেই হবে না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। অপুষ্ট মা থেকে অপুষ্ট সন্তান জন্ম দেওয়ার যে দুষ্টচক্র, তা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হবে।