চিত্র পাল্টায়নি পুরান ঢাকার

প্রতিদিন নিয়ম করে চুড়িহাট্টায় আসেন সত্তর ছুঁই–ছুঁই সাহেব উল্লাহ। ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলার যে দোকানটিতে তাঁর দুই ছেলে জীবিকার পসরা নিয়ে বসতেন, তার আশপাশে ঘোরেন। তাঁর কেবলই মনে হয়, এই বুঝি দুই ছেলের কেউ একজন এসে তাঁকে বাসায় এগিয়ে দেবেন। কিন্তু ব্যাকুল সাহেব উল্লাহর কানে আর ‘আব্বা’ ডাকটি পৌঁছায় না। পুড়ে অঙ্গার হয়ে তাঁর দুই ছেলে চলে গেছেন না–ফেরার দেশে।

সাহেব উল্লাহ বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু সেখানেও অস্থিরতা। চার বছরের নাতি শামসুল আরেফিন দৌড়ে এসে জানতে চায়, ‘বাবা আসে না কেন?’ সাহেব উল্লাহ কোনো উত্তর দেন না। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া মাসুদ রানা ও মাহবুবুর রহমান ছিলেন তাঁর বড় দুই ছেলে। দুই ভাই ‘এম আর টেলিকম’ চালাতেন, এর আয়ে চলত সংসার।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিজেদের দোকানেই দগ্ধ হয়ে মারা যান মাসুদ ও মাহবুব। এ দুজনসহ ওই ঘটনায় ৭১ জনের মৃত্যু হয়। সেই অগ্নিকাণ্ডের পর মাস ঘুরেছে। কিন্তু পুরান ঢাকার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। দুর্ঘটনার পর গুদাম সরাতে সরকারের সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স অভিযান চালালেও এই ব্যবসা বন্ধ হয়নি। চুড়িহাট্টা মোড়ে দাঁড়িয়েই দুই ছেলে হারানো সাহেব উল্লাহ বলছিলেন, ‘এত মানুষ মরে গেল। সবকিছু তো আগের মতোই চলছে।’

অগ্নিকাণ্ডটির সূত্রপাত ছিল ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার একটি সুগন্ধির গুদাম থেকে। ঘটনার পরদিন আবাসিক ভবনের দুই মালিকের ছেলের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হলেও পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ১৮ দিন পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন তাঁরা। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুরাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘তদন্ত চলছে।’

অভিযান নিয়ে প্রশ্ন

চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাসায়নিক, প্লাস্টিক ও পলিথিনের গুদাম এবং কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। তবে অভিযানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে পড়ে টাস্কফোর্স।

ব্যবসায়ীদের দাবি, প্লাস্টিক থেকে আগুন লাগে না, ছড়ায়ও না। এমন দাবির পর ১০ মার্চ প্লাস্টিককে অভিযানের আওতামুক্ত ঘোষণা করেন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। এরপর থেকে শুধু রাসায়নিক ও পলিথিনের কারখানা ও গুদামের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এই এলাকায় নামে-বেনামে কয়েক হাজার রাসায়নিক ও প্লাস্টিক গুদাম রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ গুদামের সন্ধান তাঁরা পাচ্ছেন না।

গতকাল দুপুরে চকবাজারের উর্দু রোডের বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন ও আবদুল ওহাবের মতে, লোক দেখানো অভিযান চলছে।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউম মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বেলায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যত দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে, তত দ্রুত তাঁরা এই এলাকা ছেড়ে যাবেন। তাঁর দাবি, যে ২৯টি কেমিক্যাল নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলো পুরান ঢাকায় এখন আর নেই। তবে চোরাইভাবে কেউ তা কেনাবেচা করে থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে চুড়িহাট্টা

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর মাস ঘুরলেও এখনো চুড়িহাট্টা মোড়ে প্রতিদিন লোকজন ভিড় করেন। গতকাল দুপুরেও সেই চিত্র দেখা যায়। আশপাশের প্লাস্টিকের দানার দোকানগুলো তাদের ব্যবসা পুরোদমে শুরু করেছে। পুড়ে যাওয়া চারটি ভবনের দুটির মেরামতের কাজও শুরু হয়েছে।

চুড়িহাট্টা মোড়ে পাঁচটি সড়ক এসে মিশেছে। মোড় থেকে শেখ আজগর লেনের দিকে যে সড়কটি গেছে, সেখানে ছোট্ট মুদির দোকান রয়েছে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের মো. আলমগীরের। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আলমগীরের বড় ছেলে মো. পারভেজ দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। আগুনের তাপে আলমগীরের দোকানের সব জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মাত্র চার দিন আগে তিনি আবার নতুন করে দোকান শুরু করেছেন। তিনি বলেন, ছেলে তো মারা গেছেই। ছেলের লাশ নেওয়ার সময় ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল, আর কেউ কিছু দেয়নি। ধারদেনা করে দোকানের কাজ শুরু করেছেন।

ওয়াহেদ ম্যানশনের বাঁ পাশের ছয়তলা ভবনটিরও সংস্কারকাজ শুরু করেছেন এর মালিক মো. আবদুল আজম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সবকিছু গুছিয়ে নিতে তাঁর ৩০–৩৫ লাখ টাকা খরচ পড়বে।

২৭টি রাসায়নিক গুদামে সিলগালা

অগ্নিকাণ্ডের পর গত সোমবার পর্যন্ত ৩৫টি রাসায়নিক গুদামের মালিককে মালামাল সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সরকারের সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স। ১৬২টি রাসায়নিক ও প্লাস্টিকের কাঁচামালের গুদামের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ২৭টি রাসায়নিক গুদামে সিলগালা করা হয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মাত্র ১৬টি প্রতিষ্ঠান রাসায়নিক ও প্লাস্টিকের গুদাম সরিয়ে নিয়েছে। বাকিগুলো আগের অবস্থানেই রয়ে গেছে।

ডিএসসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদার প্রথম আলোকে বলেন, ২০১০ সালে নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদাম এবং দোকানের ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ আছে। এখন পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত বলবৎ আছে। এ ছাড়া আগে যাঁরা ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছেন, তাঁদের নবায়নও বন্ধ আছে। নতুন করে কাউকে আর পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না।

গুদাম পাচ্ছে না টাস্কফোর্স

গত সোমবার চকবাজারের জয়নাগ রোডের ১৯ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালায় টাস্কফোর্স। এ সময় লামিয়া এন্টারপ্রাইজে নিষিদ্ধ রাসায়নিক পাওয়া যায়। পরে প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। একই দিন জুড়িয়াটুলী লেনের ৩৬/১ নম্বর হোল্ডিংয়ে গিয়ে আরেকটি রাসায়নিকের গুদামের সন্ধ্যান পায় টাস্কফোর্স। তখন এই গুদামের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। মালামাল সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার বেলা তিনটার দিকে এই গুদামের মালামাল আগের অবস্থায় দেখা গেছে। মালিক আবুল কালামকে পাওয়া যায়নি।

তবে এরই মধ্যে টাস্কফোর্সের অভিযানেও ঢিলেঢালা ভাব শুরু হয়েছে। আগামী ১ এপ্রিল পর্যন্ত অভিযানের কথা থাকলেও মঙ্গলবার অভিযান পরিচালনা করেনি টাস্কফোর্স দল-৩–এর সদস্য সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, আগের মতো রাসায়নিক পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা তাঁদের মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু কোথায় নিচ্ছেন, কীভাবে নিচ্ছেন, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারেননি।