পানি-স্যানিটেশন বরাদ্দে ৪ ওয়াসা আর রাজনীতির প্রাধান্য

দেশে পানি ও স্যানিটেশন খাতে বরাদ্দের ৬০ ভাগের বেশি চলে যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী নগরের চার ওয়াসায়। ছোট শহর ও গ্রামে থাকা মোট জনসংখ্যার তিন–চতুর্থাংশ মানুষের জন্য বরাদ্দ ২০ ভাগেরও কম। অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে আবার রাজনৈতিক বিবেচনাও প্রাধান্য পায়। আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইড, ইউনিসেফ ও পিপিআরসির এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।

গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, পানি ও স্যানিটেশন খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য এখনো প্রকট। দুর্গম পাহাড়, চর বা উপকূলীয় এলাকায় বরাদ্দ চাহিদার তুলনায় অনেক কম।

পানি ও স্যানিটেশন খাতে বাজেট বরাদ্দ, বৈষম্য ও সমতা শীর্ষক গবেষণাটি প্রতিবেদনটি গত বুধবার রাজধানীতে প্রকাশ করা হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে পূরণীয় জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ৬–এ সবার জন্য নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ আছে। সরকারেরও এ প্রতিশ্রুতি পূরণের লক্ষ্য আছে।

এ গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেছেন, ‘পানি ও স্যানিটেশন খাতে নগর ও গ্রামের মধ্যে বরাদ্দের ক্ষেত্রে সমতা না আনা গেলে এবং চলমান বৈষম্য না কমানো গেলে এসডিজির প্রতিশ্রুতি পূরণ দুরূহ হবে। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) তুলনায় এসডিজির চ্যালেঞ্জ অনেকে বেশি।’

গবেষণায় বলা হয়েছে, গত তিন অর্থবছরে চার ওয়াসা ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ পেয়েছে। এটি পানি ও স্যানিটেশন খাতে দেশের মোট বরাদ্দের ৬৬ শতাংশের বেশি। এই সময়ে বাকি মেট্রোপলিটন শহরগুলো পেয়েছে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বাকি দেশের পৌরসভা ও গ্রামের জন্য বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি।

সিটি করপোরেশনগুলোর মধ্যে ঢাকা গত তিন বছর ধরেই বরাদ্দ তালিকায় শীর্ষে থেকেছে। গবেষকেরা মনে করেন, জনসংখ্যার চাহিদার নিরিখে তা হয়তো ঠিকও। কিন্তু অন্য সিটিগুলোতে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে বরাদ্দ অনেক কম। তবে খুলনা, গাজীপুর, বরিশালে পানি ও স্যানিটেশনে উল্লেখযোগ্য কোনো বরাদ্দ ছিল না। তিন সিটিতেই বিএনপির মেয়র ছিলেন। কুমিল্লা সিটিতে কিছু বরাদ্দ থাকলেও তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম, এ কথা খোদ মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কুর। গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে সাক্কু বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় পানি ও স্যানিটেশন খাতে বরাদ্দ কম। যদি ঢাকা ও চট্টগ্রামের তুলনা করি তাহলে এ বরাদ্দ নগণ্য। এটা ঠিক আমার সিটি ছোট। কিন্তু বরাদ্দের ক্ষেত্রে দুই সিটির তুলনায় এখানে বরাদ্দ একেবারে আকাশ-পাতাল ব্যবধান।’

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক বিবেচনা যে বিচার্য বিষয় ছিল, বাজেট বরাদ্দের চিত্র দেখে এমনটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়।’

পানি ও স্যানিটেশনে বরাদ্দে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়—এ কথা মানতে নারাজ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কে কোন দল করে সেই বিবেচনা থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় না। আমার কাছে মূল বিবেচ্য ভালো কাজ। তা করলে কারও বরাদ্দই কম হবে না।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম, উপকূলীয় অঞ্চল এবং চরাঞ্চল দেশের দুর্গম এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এসব এলাকায় সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের চাহিদা এখনো ব্যাপক।

চরাঞ্চলের মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর জোট ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স সূত্র জানায়, দেশে চরে বাস করা মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। চলতি অর্থবছরে চরের পানি ও স্যানিটেশন বরাদ্দ ২২০ কোটি টাকা। অ্যালায়েন্সের সদস্যসচিব জাহিদ রহমান বলেন, ‘এ বরাদ্দ একেবারে অপ্রতুল।’

পার্বত্য তিন জেলায় পানি ও স্যানিটেশন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে স্থানীয় বেসরকারি সংগঠন গ্রিন হিল। এর নির্বাহী পরিচালক মং থোয়াই চিং প্রথম আলোকে বলেন, ‘পানি ও স্যানিটেশনে এখানে যে বরাদ্দ আসে এর বেশির ভাগই যায় জেলা বা উপজেলা সদর এলাকায়। এখনো পার্বত্য এলাকার ৬০ শতাংশ মানুষ সরকারি হিসাবে নিরাপদ পানি বলতে যা বোঝায় তা পায় না।’

রাঙামাটির জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে স্বীকার করেন, জেলার ৪২ শতাংশ মানুষ এখন সুপেয় পানি পায়। তিনি বলেন, ‘এখানে প্রয়োজনের তুলনায় বাজেট অপর্যাপ্ত।’

গবেষণায় দেখানো হয়েছে, প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়লেও পানি ও স্যানিটেশন খাতে বরাদ্দ আনুপাতিক হারে বাড়ছে না। বরাদ্দ যতটুকু আছে গত তিন বছরে তা ব্যবহারের হার কমছে। ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটের বরাদ্দ বিশ্লেষণ করা হয়। ৯ অর্থবছরে জিডিপির আকার আড়াই গুণের মতো বাড়লেও পানি ও স্যানিটেশন খাতে মাত্র ৫৬ শতাংশ বেড়েছে। গত তিন বছর ধরে বরাদ্দ ব্যবহারের হার প্রায় ৮০ শতাংশ। এর আগের দুই বছরে প্রায় শতভাগ ব্যয় হতো।

ওয়াটার এইডের বাংলাদেশীয় প্রধান খায়রুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের দারিদ্র্য বান্ধব বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা জানি। কিন্তু দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের মানুষের জন্য সুপেয় পানি ও নিরাপদ স্যানিটেশন খাতে বরাদ্দে সরকারের সেই পরিচয় আমরা পাই না। পার্বত্য এলাকা, চর ও উপকূলের ক্ষেত্রে এটি একেবারেই সঠিক।’

দুর্গম এলাকায় বরাদ্দ কম হচ্ছে না বলেই মনে করেন মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বড় সিটিতে চাহিদা বেশি। সেখানে কিছু বরাদ্দ বেশি থাকতেই পারে। তবে এর জন্য কোনো অঞ্চলকে বৈষম্য করা হয় না।’