বিএনপি পল্লির বাতিল করা প্লট সরকারের নিয়ন্ত্রণে

.
.

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত-সংলগ্ন প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় ২০০৩ সালে তৎকালীন বিএনপি জোট সরকার হোটেল–মোটেলের জন্য ইজারা দেয় ৫৯টি প্লট। এর মধ্য থেকে ৫৭টি প্লট বাতিল করেছেন উচ্চ আদালত। ইতিমধ্যে ৫০টি প্লট বুঝে নিয়েছে জেলা প্রশাসন। এসব প্লট বিএনপি পল্লি নামে পরিচিত। বাতিল প্লট জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে ইজারা বাতিল হওয়া কয়েকটি প্লটের জমিতে নির্মিত দুই শতাধিক দোকানপাট, হোটেল রেস্তোরাঁ উচ্ছেদ নিয়ে আতঙ্কে আছেন ব্যবসায়ীরা। বেশির ভাগ দোকানপাট সুগন্ধা ও কলাতলী সড়কে।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ইজারা চুক্তি বাতিল হওয়া ৫৭টি প্লটের মধ্যে ৫০টি প্লট আমরা ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বুঝে পেয়েছি। প্রতিটি প্লটের আয়তন এক একর করে। সেখানে সরকারের পক্ষে সাইনবোর্ড তুলে দেওয়া হয়েছে। বাকি কয়েকটি প্লটে নির্মিত দোকানপাট উচ্ছেদ করা হবে। দোকানপাটগুলো উচ্ছেদ নিয়ে হাইকোর্টে মামলা বিচারাধীন আছে। এ কারণে কিছুটা দেরি হচ্ছে।’
জেলা প্রশাসক বলেন, প্লটের ইজারাদারেরা সরকারকে বিবাদী করে সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করেছিলেন। প্রায় ১০ বছর আইনি লড়াই শেষে উচ্চ আদালতের রায়ে সরকার ৫৭টি প্লট ফিরে পেয়েছে। ফলে প্লট বাতিলের সরকারের সিদ্ধান্ত বৈধ ও বহাল থাকল।
জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৫ ধারা অনুসারে তৎকালীন সরকার কক্সবাজার সৈকতের ওই এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ২০০৩ সালে সমুদ্রসৈকত–সংলগ্ন ১৩০ একর সরকারি খাসজমি নিয়ে হোটেল-মোটেল জোন গড়ে তোলে। ওই জমিতে ৮৭টি প্লট তৈরি করে দলীয় মন্ত্রী, সাংসদ এবং তাঁদের আত্মীয়–স্বজন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামে ৯৯ বছরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে কিছু প্লট চড়া দামে হাতবদল হয়েছ। ওই সরকারের বরাদ্দের চুক্তি অনুসারে নির্মাণকাজ শেষ না করায় ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি সংসদীয় কমিটি এবং ভূমি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বিভাগীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক ৫৯টি প্লটের ইজারা বরাদ্দ বাতিল করে। সরকারের এ আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ইজারাদারেরা হাইকোর্টে রিট করেন। দীর্ঘ শুনানির পর আদালত গত ফেব্রুয়ারি মাসে তা খারিজ করে দেন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, চুক্তির শর্ত ছিল এক বছরের মধ্যে কাজ শুরু করতে হবে এবং তিন বছরের মধ্যে তা শেষ করতে হবে, কিন্তু ইজারাদারেরা তা মানেননি।

উচ্ছেদ আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা
সুগন্ধা পয়েন্টের দক্ষিণ পাশে একটি প্লটে সি-ইন মার্কেট তৈরি করেন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ এলাকার ব্যবসায়ী নুরুল আবছার। গত বৃহস্পতিবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, নিচতলার ৩৫টির বেশি দোকানপাটের সাইনবোর্ড তুলে ফেলা হয়েছে। তবে দোকানগুলোতে কেনাবেচা হচ্ছে। দ্বিতীয়তলায়ও সাইনবোর্ড নেই। সেখানে কক্ষভাড়া নিয়ে বসতি করছেন বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার লোকজন। মার্কেটের সামনে জেলা প্রশাসনের ‘লাল সাইনবোর্ড’ টাঙানো।
কারণ জানতে চাইলে একটি দোকানের কর্মচারী সাজেদুল ইসলাম বলেন, হাইকোর্টের রায়ে এই প্লটের মালিক এখন সরকার। তাই জেলা প্রশাসন লাল সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে, যেকোনো মুহূর্তে দোকানপাট উচ্ছেদ করে মামলা দিতে পারে জেলা প্রশাসন, এই আতঙ্কে দোকানের নামফলকও সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
মার্কেটের মালিক নুরুল আবছার বলেন, ইজারা চুক্তির শর্ত ভঙ্গের কারণে তাঁর প্লটের ইজারা চুক্তি বাতিল করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। এর বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়ার কোনো সুযোগ তাঁদের নেই। তাই ব্যবসায়ীরা উচ্ছেদ আতঙ্কে ভুগছেন। এই মার্কেটে ৪০টি দোকান ও ১৮টি আবাসিক কক্ষ রয়েছে।
কলাতলী সৈকত সড়কের পশ্চিম পাশে মো. রফিকুল আলম, আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ, কাজী শামসুজ্জামান, সাবেক সাংসদ আলমগীর মো. মাহফুজ উল্লাহ ফরিদ, ফিরোজ বখত তোয়াহা, মোকতার আহমদ, এইচ এম আবছারসহ অনেকের প্লটে তোলা হয়েছে জেলা প্রশাসনের লাল সাইনবোর্ড।
কলাতলী সড়কের পশ্চিম পাশে একাধিক বাতিল প্লটে তৈরি হয়েছে শতাধিক শুঁটকি মাছ বিক্রির দোকান, রেস্তোরাঁ, বিভিন্ন পরিবহন সংস্থার বাস, জাহাজের টিকিট বিক্রির কাউন্টার, ট্যুরিজম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সেখানে কেনাকাটায় ভিড় জমান পর্যটকেরা।
একটি পরিবহন সংস্থার ব্যবস্থাপক সালামত উল্লাহ বলেন, দোকানঘর ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন তাঁরা। জেলা প্রশাসন লাল সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দিলেও উচ্ছেদের ব্যাপারে এখনো লিখিতভাবে কিছুই জানানো হয়নি তাঁদের।
আরেকটি রেস্তোরাঁর মালিক গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘পাঁচ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে ঘরটি ভাড়া নিয়ে পর্যটকদের খাবার বিক্রি করছি। উচ্ছেদ করলে কোথায় যাব ভেবে পাচ্ছি না।’
জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, বাতিল প্লটগুলো হোটেল–মোটেল জোন এলাকায়। সেখানে কী হবে—এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে জমিগুলো কাজে লাগানো হতে পারে।