খুলনায় গণহত্যা জাদুঘর

খুলনার ‘গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘরে’ মুক্তিযুদ্ধের ছবি ও সংরক্ষিত বিভিন্ন স্মারক শিশুসন্তানকে দেখাচ্ছেন এক বাবা। ২৪ মার্চ নগরের সাউথ সেন্ট্রাল সড়কে।  সাদ্দাম হোসেন
খুলনার ‘গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘরে’ মুক্তিযুদ্ধের ছবি ও সংরক্ষিত বিভিন্ন স্মারক শিশুসন্তানকে দেখাচ্ছেন এক বাবা। ২৪ মার্চ নগরের সাউথ সেন্ট্রাল সড়কে। সাদ্দাম হোসেন

খুলনার ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’। এখানে আছে বাঙালির মুক্তি, স্বাধীনতার স্পৃহা আর মুক্তিযুদ্ধকালের সবচেয়ে মর্মন্তুদ পর্বের অসংখ্য নিদর্শন। সেগুলোর সামনে দাঁড়ালে দর্শনার্থীর চোখে ভেসে ওঠে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মমুহূর্তের যন্ত্রণার দিনগুলো।

১৯৭১ সালের ১৯ মে। খুলনার বটিয়াঘাটার বাদামতলা গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন সৌরভী গোলদার ও মাধবচন্দ্র বৈরাগী। সেদিনের নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হয়ে আছে তাঁদের রক্তমাখা কাপড়। মাধবচন্দ্রের পকেটে পাওয়া যায় রক্তমাখা কিছু টাকা। সেই টাকা হয়ে আছে বুলেটের আঘাতে থমকে যাওয়া একটি মুহূর্তের স্মারক। খুলনা শহরে এই জাদুঘরের শহীদ গ্যালারিতে এসব নিদর্শনের দেখা মেলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের উৎসাহে ২০১৪ সালের ১৭ মে খুলনায় এই জাদুঘর যাত্রা শুরু করে। শুরুতে ময়লাপোতা এলাকার শেরেবাংলা রোডের একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৫ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নগরের ২৬ সাউথ সেন্ট্রাল রোডের দ্বিতল একটি বাড়ি উপহার দেন। সংস্কারের পর ২০১৬ সালের ২৬ মার্চ সেই বাড়িতে স্থানান্তর হয় জাদুঘরটি। ১৯৭১ সালের গণহত্যা-নির্যাতনের নিদর্শন সংরক্ষণ, বধ্যভূমি ও গণকবর-সংক্রান্ত তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা, গণকবর ও বধ্যভূমি চিহ্নিত করা এবং গবেষণা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে তারা।

জাদুঘর কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি দেশের একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর। এটি খুলনায় স্থাপনের অন্যতম কারণ চুকনগর বধ্যভূমি এখানে অবস্থিত। চুকনগরে ১৯৭১ সালের সবচেয়ে বড় ও নৃশংস গণহত্যাটি চালিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরেরা।

তবে শুধু খুলনা অঞ্চল নয়, মুক্তিযুদ্ধে সারা দেশের বিভিন্ন গণহত্যার নিদর্শন জায়গা পেয়েছে এই জাদুঘরে। শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর পাঞ্জাবি, শহীদুল্লা কায়সারের দুটি টাই ও ডায়েরি, বিবিসির সংবাদদাতা নিজামউদ্দীন আহমেদের কোট, সেলিনা পারভীনের কলম ও শাড়ি, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পাঞ্জাবি, পায়জামা ও পাণ্ডুলিপি, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার লেখা বই, ডা. আলীম চৌধুরীর ভিজিটিং কার্ড, ল্যাম্প, ডেন্টাল টুলকিট ও ডায়েরি আছে জাদুঘরে। শহীদ পরিবারের সদস্যরা এগুলো জাদুঘরে দান করেছেন।

জাদুঘরের প্রথম গ্যালারিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে কাচঘেরা কয়েকটি বাক্স। একটি বাক্সে আছে একাত্তরের অস্থির সময়ে স্ত্রী জোহরাকে লেখা তাজউদ্দীন আহমদের চিঠি। সে সময়ের জনপ্রিয় বক মার্কা (king stork) সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে মাত্র দুই লাইনের সেই চিঠি। তাতে লেখা ‘জোহরা, পারলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সাথে মিশে যেয়ো। ঐ মতো ব্যবস্থা (দুই) ।’

একাত্তরে শহীদ হন সেকান্দার আলী সেরনিয়াবাতের তিন সন্তান। ১৯৭৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে সেকান্দারকে তিন হাজার টাকার চেক দেন বঙ্গবন্ধু। শহীদ সন্তানদের শেষ স্মৃতি হিসেবে সেই চেকের টাকা আর তোলেননি সেকান্দার। চেকটি রাখা আছে পাশের একটি বাক্সে।

জাদুঘর সূত্র জানায়, জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই আছে ৫ হাজারের ওপর। গণহত্যা ও নির্যাতনের ওপর বাঁধানো ছবি আছে ১৫৫টি। আগরতলার শিল্পীদের আঁকা ‘শিল্পীর চোখে গণহত্যা-নির্যাতন আর্ট’ শিরোনামের ছবি আছে ১২টি। ২০১৫ সালে ‘শিল্পীর চোখে গণহত্যা নির্যাতন’ নামে একটি আর্ট ক্যাম্প হয়, সেখানকার ছবি আছে ১৭টি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও প্রামাণ্যচিত্রের ২৫০টি সিডিসহ মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার নানান নিদর্শন আছে।

জাদুঘরের ১১ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গণহত্যা জাদুঘর এটি। খুব কম সময়ের মধ্যে আমরা মোটামুটি জাদুঘরটিকে দাঁড় করাতে পেরেছি। নিদর্শনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দর্শক ক্রমেই বাড়ছে। গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’

ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সোমবার বাদে প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এবং নভেম্বর থেকে জানুয়ারি সময়ে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলা থাকে। প্রতি শুক্রবার এটি বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। জাদুঘরে প্রবেশ ফি ২ টাকা।