নদী ও নৌপথকে বাঁচাতেই হবে

সৈয়দ মনোয়ার হোসেন
সৈয়দ মনোয়ার হোসেন

নৌপথের ভাগ্য নদীর সঙ্গে পাকে পাকে বাঁধা। নদী বাঁচলে নৌপথ বাঁচবে। নদীকে বাঁচাতে হবে পরিবেশ ও জীবনের বৃহত্তর সুদূরপ্রসারী স্বার্থেও। আর নৌপথকে বাঁচাতে হবে নদীমাতৃক এই দেশে নৌপরিবহনের উপযোগিতার স্বার্থে।

নৌপরিবহনের সুবিধা অনেক। এতে খরচ কম। এটা জ্বালানি সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব এবং তুলনামূলক নিরাপদ। রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের অভাবে সরকারের কর্মকৌশলে নৌপরিবহন দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল। নৌপথের ক্রমহ্রাসমান দৈর্ঘ্য এই সুদীর্ঘ অবহেলা-অনাচারেরই প্রতিচ্ছবি।

ব্রিটিশ শাসনামলে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল ১৪ হাজার ৩৮ কিলোমিটার (ইনল্যান্ড নেভিগেশন অন গ্যাঞ্জেটিক রিভার্স; ক্যালকাটা, ১৯৩৩; জে জনস্টন)। পাকিস্তান আমলে পানির মৌসুমে ছিল প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার, শুকনো মৌসুমে ৮ হাজার কিলোমিটার (সার্ভে অন ইনল্যান্ড ওয়াটার অ্যান্ড পোর্টস; ১৯৬৩-৬৭; নেডেকো)। জরিপ বলছে, ১৯৮০-এর দশকের শেষ ভাগে পানির মৌসুমে নৌপথ ছিল ৫ হাজার ৯৬৮ কিলোমিটার, আর শুকনোর সময় ৩ হাজার ৬০০ কিলোমিটার (বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট মাস্টারপ্ল্যান; ১৯৮৯; ডিএইচভি কনসালট্যান্টস; দ্য নেদারল্যান্ডস)।

৩০ বছরে সার্বিক কোনো জরিপ হয়নি। সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতির কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য হাতে নেই। তবে বিআইডব্লিউটিএ বলছে, গত কয়েক বছরে ব্যাপক খননকাজ হয়েছে। এর ফলে শুকনো মৌসুমে নাব্য নৌপথের দৈর্ঘ্য বেড়ে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটারে উঠেছে।

ক্রমহ্রাসমান নাব্যতার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন দেখি মোট জাতীয় পরিবহনে নদীপথের হিস্যায়। ১৯৭৫ সালে ৩৭ শতাংশ মালামাল পরিবহন হতো নদীপথে। তখন ১৬ শতাংশ যাত্রী নৌপথে যাতায়াত করত। এখন এ হিস্যা কমে যথাক্রমে ১৬ শতাংশ এবং ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে (বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদন)।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারের নীতি ও উন্নয়ন কর্মকৌশলে নৌপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নকে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সড়কপথ আরও সম্প্রসারণের সুযোগ সীমিত। রেলপথের আছে অন্তর্নিহিত দুর্বলতা। সুতরাং ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য নৌপথ ছাড়া গতি নেই। দারিদ্র্য দূর করার মন্ত্রও আছে নৌপরিবহনে।

কিন্তু নৌপরিবহন ব্যবস্থাকে আবার বাঁচিয়ে তোলার পথে বাধা অনেক। প্রথমেই আসে নদীপথের নাব্যতা পরিস্থিতির কথা। নদীপথ পরিবর্তিত হচ্ছে, নদী সংকীর্ণ হচ্ছে। প্রধান কারণ হিসেবে একদিকে চিহ্নিত করা হয় প্রাকৃতিক গঠনের বিবর্তন তথা মরফোলজিক্যাল প্রক্রিয়াকে। অন্যদিকে দায়ী করা হয় দেশের ভেতর ও বাইরে পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা এবং পানি তুলে নেওয়াকে।

আরও অনেক কারণ ইদানীং আলোচিত হচ্ছে। যেমন নদীর দখল ও দূষণ এবং নদীকে ভাগাড় হিসেবে ব্যবহারের অভ্যাস। বাংলাদেশের প্রায় ৩২টি নদীবন্দর ও শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ নৌযান ভেড়ানোর স্থানে (ল্যান্ডিং স্টেশন) নদী দখল ও দূষণের সচিত্র প্রতিবেদন আছে। তা দখল-দূষণের অপ্রতিরোধ্য প্রবণতাকে স্পষ্ট করে।

নদী–তীরবর্তী স্থানে প্রতিষ্ঠিত কলকারখানা, আবাসন প্রকল্প, বালু-পাথরের ব্যবসা নদীকে কীভাবে গ্রাস করে নিয়েছে, বিআইডব্লিউটিএর চলমান অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ–প্রক্রিয়ায় তা স্পষ্ট হয়েছে। চলমান এ উচ্ছেদ অভিযানের দৃঢ়তায় মনে হচ্ছে, দখলদারদের প্রভাব-প্রতিপত্তি এবার কোনো কাজে আসছে না।

আরও একটি বিষয় সবার নজরে এসেছে। নদীকে সম্পূর্ণ মুক্ত-পরিচ্ছন্ন করার জন্য বিআইডব্লিউটিএর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই। এগুলোর মধ্যে আছে রাজউক, ঢাকা ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তর। একবার উচ্ছেদের পর সেটা টেকসই করার জন্য সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার অভাব আছে বলে প্রতীয়মান হয়।

নদীর তীরভূমি রক্ষায় বিআইডব্লিউটিএর একটি চলতি প্রকল্প আছে। একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে। এটা আশার কথা। কিন্তু সংশয়ের কথা এই যে বিআইডব্লিউটিএর এখতিয়ারের সংবিধিবদ্ধ সীমাবদ্ধতা আছে। সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা ওই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারে।

সৈয়দ মনোয়ার হোসেন, পরামর্শক, ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম)