ভোটের এত ফারাক কীভাবে

এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অনেক এলাকায় ভোটারের খরা দেখা গেছে। ফাইল ছবি
এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অনেক এলাকায় ভোটারের খরা দেখা গেছে। ফাইল ছবি

দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলা নিয়ে সিলেট-৩ সংসদীয় আসন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ১ লাখ ৭৬ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হন। আড়াই মাসের মাথায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এই তিন উপজেলা মিলিয়ে মোট ভোট পড়েছে ৮৮ হাজার ৪৩৭, যা সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পাওয়া ভোটের চেয়ে ৮৭ হাজার কম। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী এই আসনে পেয়েছিলেন ৯৭ হাজারের বেশি ভোট।

কেবল সিলেট নয়, এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অনেক এলাকায়ই ভোটের এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। ভোটার উপস্থিতির এই খরা দেখে বিশ্লেষকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে কি আওয়ামী লীগের সমর্থক ভোটাররাও ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন?

যদিও একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। বেশির ভাগ জায়গায় আগের রাতে ‘বাক্স ভর্তি’ করার অভিযোগ আছে। তা ছাড়া, আওয়ামী লীগের পক্ষে যে ভোট দেখানো হয়েছিল, তা অতিরঞ্জিত বলে নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা বলে আসছেন।

একই অভিযোগ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও। প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ১২০ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা। ৩০টি উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদেও প্রতিদ্বন্দ্বী পাওয়া যায়নি। অনেকটা একতরফা এই নির্বাচনে বেশির ভাগ জায়গায় মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর, যাঁরা আওয়ামী লীগেরই নেতা।

পাঁচ ধাপে মোট ৪৮০টি উপজেলায় ভোট হচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ভোট পড়ার হার ছিল ৪৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপে তা আরও কমে যায়। দ্বিতীয় ধাপে যেসব উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ভোট হয়, সেসব উপজেলায় ভোট পড়েছে গড়ে ৪১ দশমিক ২৫ শতাংশ। যেসব উপজেলায় চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় কেবল দুই ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট হয়েছে, সেসব উপজেলার ভোটের হার পাওয়া যায়নি। সেসব মেলানো হলে ভোটের হার আরও কমতে পারে। প্রথম দুই ধাপে ১৯৪টি উপজেলায় ভোট হয়েছে। গত রোববার তৃতীয় ধাপে ১১৭টি উপজেলায় যে নির্বাচন হয়েছে, সেখানে ভোট পড়ার হার ৪১ দশমিক ৪১ শতাংশ।

এর আগে ২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে গড়ে ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে এই উপজেলা নির্বাচনের আগে ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল, যার ৭৬ শতাংশই আওয়ামী লীগ পেয়েছিল। এর দুই মাসের মাথায় ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়ে ৩০ শতাংশ। এটা কতটা স্বাভাবিক? বিরোধী সমর্থকদের পাশাপাশি সরকার-সমর্থক ভোটাররাও কি ভোটদানে বিরত থেকেছেন? এক নিবন্ধে এ প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন (২০ মার্চ, প্রথম আলো)।

ঢাকা সিটির পর উপজেলার তৃণমূলের নির্বাচনেও ভোটারের খরা চলছে। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এবার মোট ভোট পড়ে ৩৬ হাজারের বিছু বেশি। অথচ আড়াই মাস আগে সংসদ নির্বাচনে এই উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী একাই ভোট পান ১ লাখ ২৪ হাজারের বেশি ভোট।

একইভাবে লালপুর ও বাগাতিপাড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত নাটোর-১ আসনে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২ লাখ ৪৬ হাজারের বেশি ভোট। আর উপজেলা নির্বাচনে দুটি মিলিয়ে ভোট পড়েছে অর্ধেকের কম, ১ লাখ ১১ হাজার ৪৯৫ ভোট।

সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের মোট ভোটের তুলনা করলে প্রায় একই চিত্র পাওয়া যায় নেত্রকোনার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, মোহনগঞ্জ, মদন ও খালিয়াজুরি; ফরিদপুরের বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা ও মধুখালী এবং বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলাসহ অনেক উপজেলায়। বগুড়ার সদর উপজেলার চিত্র আরও খারাপ। উপজেলা নির্বাচনে এখানে ভোট পড়ে ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশ।

তাহলে কি আওয়ামী লীগের অনেকেও ভোট দিতে যাচ্ছেন না—এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় নির্বাচন আর উপজেলা নির্বাচন এক করা যাবে না। জাতীয় নির্বাচনে ভোটাররা ঠিক করেন কে দেশ চালাবে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাবে। সে কারণে আগ্রহ অনেক বেশি থাকে। উপজেলা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এটি নেই, তাই স্বভাবত আগ্রহ একটু কম থাকে।

জাতীয় নির্বাচনে ‘ভোট ডাকাতির’ অভিযোগ এনে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্ট ও বাম গণতান্ত্রিক জোট। তারা এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ফলে তারা উপজেলা নির্বাচন বর্জন করেছে। এ অবস্থায় স্থানীয় সরকারের এমন একটি নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহী করার ক্ষেত্রে ইসির কোনো করণীয় নেই বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা।

তবে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার শঙ্কিত। তিনি ১৮ মার্চ এক বিবৃতিতে বলেছেন, একতরফা উপজেলা নির্বাচনের কারণে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে আগ্রহী নন। এই নির্বাচনবিমুখতা গণতন্ত্রবিমুখতায় পর্যবসিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, জাতীয় ও উপজেলা নির্বাচনের ভোট নিয়ে ইসির তথ্যগুলো সঠিক হলে প্রমাণিত হয়, উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের অনেকেও ভোট দিতে যাচ্ছেন না। মানুষ মনে করছেন, যিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন, তাঁর জয় নিশ্চিত। ভোট দিলেও তেমন কিছু যায় আসে না। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়া বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ফলে ভোটারদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে।