বাবার মুখ দেখবে না মিজানুরের অনাগত সন্তান

বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত মিজানুর রহমান লিটন। কোলে তাঁর শিশু সন্তান। এই দৃশ্য কেবলই এখন স্মৃতি। ছবি: সংগৃহীত
বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত মিজানুর রহমান লিটন। কোলে তাঁর শিশু সন্তান। এই দৃশ্য কেবলই এখন স্মৃতি। ছবি: সংগৃহীত

সাড়ে চার বছর বয়সী একমাত্র ছেলেসন্তানের জনক শেখ মো. মিজানুর রহমান ওরফে লিটন (৩৪)। আবারও বাবা হতে যাচ্ছেন তিনি। এ খবরে ভীষণ খুশিও হয়েছিলেন মিজানুর। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি তাঁর খুশি কেড়ে নিয়েছে, আর স্বজনদের ভাসিয়েছে বিষাদের সাগরে। বৃহস্পতিবার ঢাকায় বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় না–ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি।

নিহত মিজানুর রহমানের বাড়ি খুলনার তেরখাদা উপজেলার কোদলা গ্রামে। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে তাঁর মরদেহ নিজ বাড়িতে পৌঁছায়। তখন সেখানে স্বজন ও প্রতিবেশীদের ছিল ভিড়। লাশের পাশে তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী তানিয়া বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন, একপর্যায়ে হয়ে পড়েন বাক্‌রুদ্ধ। পাশেই অনেকটা নিশ্চুপ বসে ছিল মিজানুরের ছেলেটি। স্বজনদের কান্না ও আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। মিজানুরের অনাগত সন্তান বাবার মুখ দেখবে না।

শুক্রবার বাদ জুমা পারিবারিক কবরস্থানে মিজানুরের লাশ দাফন করা হয়। স্বজন ও প্রতিবেশীরা জানান, মিজানুর সর্বশেষ চাকরি করতেন এফ আর টাওয়ারের দশম তলার হেরিটেজ এয়ার এক্সপ্রেস নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। এর আগেও তিনি ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বড় ভাই ও স্ত্রীর সঙ্গে বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া দুইটার দিকে মুঠোফোনে কথা হয় মিজানুরের। তখন তিনি বলেছিলেন, তাঁর ওখানে আগুন লেগেছে। ফোন দিতে নিষেধ করে সবাইকে দোয়া করতে বলেছিলেন।

সমুদ্রে নেমে মিজানুরের গা ভেজানোর প্রাণবন্ত এই ছবি, স্মৃতির আখরে থেকে যাবে স্বজনদের। ছবি: সংগৃহীত
সমুদ্রে নেমে মিজানুরের গা ভেজানোর প্রাণবন্ত এই ছবি, স্মৃতির আখরে থেকে যাবে স্বজনদের। ছবি: সংগৃহীত

এরপর মিজানুরের মেজ ভাই শেখ আলম ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। রাতে মিজানুরের ব্যবহৃত মোবাইলে বারবার কল দেওয়ার পর ফায়ার সার্ভিসের একজন ফোনটি রিসিভ করেন। তিনি জানান, মিজানুরের অবস্থা আশঙ্কাজনক, তাঁকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে রাখা হয়েছে। শেখ আলম ঢাকায় পৌঁছে ওই হাসপাতালে গিয়ে খবর পান, তাঁর ভাইকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হয়েছে। পরে সেখানে গিয়ে বড় ভাই ভাইকে খুঁজে পেলেন; তবে জীবিত নয়, মৃত অবস্থায়।

মিজানুরের বন্ধু কামাল উদ্দীন সোহেল বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাত নয়টার দিকে লিটনের (ডাকনাম) ফোনে কল দিয়েছিলাম। কিন্তু ফোনটি ধরেছিল ফায়ার সার্ভিসের কেউ। কলেজে আমরা ব্যাচমেট ছিলাম। ভীষণ ভালো মানুষ ছিল লিটন।’

পরিবার জানায়, মিজানুরেরা তিন ভাই, তিন বোন। তিনি ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। বড় ভাই নজরুল ইসলাম পুলিশ সদস্য এবং মেজ ভাই শেখ আলম কৃষিকাজ করেন। মিজানুর অনেক বছর ধরে ঢাকায় থাকেন। খুলনা সরকারি আযম খান কমার্স কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ২০০৭ সালে স্নাতক শেষ করে পরে ঢাকার একটি কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। ঢাকায় তাঁর সঙ্গে স্ত্রীও থাকতেন। কয়েক মাস আগে স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।

মিজানুরের বড় ভাই শেখ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘লিটনের জন্মের ১৫ দিন আগে বাবা মারা যান। আর ওর জন্মের তিন মাস ৫ দিন পর মা বিদায় নেন। এরপর বড় বোন কিছুদিন রেখেছিলেন। বছর পাঁচেক বয়স থেকে সে আমার কাছে থাকে। কেনা দুধ, মিছরির পানি খাইয়ে ওকে বড় করেছি। সেই ভাইকে নিজ হাতে দাফন করলাম। বলেন তো, এর চেয়ে আর কষ্টের কী থাকতে পারে।’