সাড়ে ১১ হাজার ভবন ঝুঁকিতে

বনানীতে এফ আর টাওয়ারে আগুনে নিহত মীর্জা আতিকুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের মাতম। গতকাল শরীয়তপুরের পূর্ব সারেঙ্গা গ্রামে নিহত ব্যক্তির বাড়িতে।  ছবি: সত্যজিৎ ঘোষ
বনানীতে এফ আর টাওয়ারে আগুনে নিহত মীর্জা আতিকুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের মাতম। গতকাল শরীয়তপুরের পূর্ব সারেঙ্গা গ্রামে নিহত ব্যক্তির বাড়িতে। ছবি: সত্যজিৎ ঘোষ
>
  • বহুতল ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা
  • অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা নেই বনানীর এফ আর টাওয়ারের
  • ফায়ার সার্ভিস জানুয়ারিতে নোটিশ দিয়েও সাড়া পায়নি

বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র বা অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনার অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু এর কোনোটিই ছিল না বনানীর এফ আর টাওয়ারের। গত জানুয়ারি মাসেও এই ভবন কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু তারা সাড়া দেয়নি। গত বৃহস্পতিবার এই ভবনেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ২৫ জন।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, নোটিশ দেওয়া ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই। আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)।

শুধু এফ আর টাওয়ারই নয়, ঢাকা মহানগরীর অন্তত সাড়ে ১১ হাজার বহুতল ভবন এমন অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা–সংক্রান্ত ফায়ার সার্ভিসের কোনো ছাড়পত্র বা অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনার (ফায়ার সেফটি প্ল্যান) অনুমোদন নেই। রাজউক ও ফায়ার সার্ভিস থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমাতে ২০০৩ সালে অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ নামে একটি আইন করে সরকার। এই আইন অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরে বহুতল ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিস থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। মূলত ভবনের সামনে সড়কের প্রশস্ততা, নকশা অনুসারে ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা, ভবন থেকে বের হওয়ার বিকল্প পথ, কাছাকাছি পানির সংস্থান, গাড়ি ঢুকতে পারবে কি না—এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে ছাড়পত্রটি দেয় ফায়ার সার্ভিস। তারপর এই ছাড়পত্র দেখিয়ে রাজউক থেকে ভবনের নকশার অনুমোদন নিতে হয়। এরপর ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করতে হয়। নির্মাণকাজ আংশিক বা পুরোপুরি শেষ হওয়ার পর ভবনটি ব্যবহারের জন্য আবার রাজউকের কাছ থেকে বসবাস বা ব্যবহারের সনদ নিতে হয়। এই সনদ দেওয়ার সময় আগে জমা দেওয়া নকশা অনুযায়ী ভবনটি নির্মিত হয়েছে কি না, তা দেখে রাজউক।

কিন্তু বাস্তবে এই প্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পন্ন করে না রাজউক। ফলে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই নির্মিত হয় বহুতল ভবন।

রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) অংশ হিসেবে ২০১৬ সালে করা এক জরিপ অনুযায়ী, ঢাকা মহানগর এলাকায় সাততলা বা তার চেয়ে উঁচু ভবন আছে ১৬ হাজার ৯৩০টি। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ৫ হাজার ২৪টি ভবন ফায়ার সার্ভিস থেকে ছাড়পত্র নিয়েছে। অর্থাৎ ১১ হাজার ৯০৬টি ভবনের অগ্নিপ্রতিরোধের প্রক্রিয়া যথাযথভাবে পালন করা হয়নি।

ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র ছাড়া এত ভবন নির্মাণ হয় কীভাবে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (ওয়্যারহাউস অ্যান্ড ফায়ার প্রিভেনশন) ওহিদুল ইসলাম বলেন, ফায়ার সার্ভিসের আইন অনুযায়ী ছয়তলার ওপর যেকোনো ভবনই বহুতল। আর রাজউকের আইন অনুযায়ী, ১০ তলা থেকে বহুতল ভবন। দুই আইনের এমন সাংঘর্ষিক অবস্থার কারণে ১০ তলার নিচের বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র চায় না রাজউক। ফলে এই ভবনগুলো অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই গড়ে উঠছে। দুই আইনের এই সাংঘর্ষিক অবস্থার অবসান দরকার বলে মত দেন তিনি।

অন্যদিকে ২০০৩ সালের আগে যে ভবনগুলো নির্মিত হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনার অনুমোদন নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে ভবনমালিক আবেদন করলে ফায়ার সার্ভিস থেকে সরেজমিনে ভবনটি পরিদর্শন করে অগ্নিনিরাপত্তায় কী কী ব্যবস্থা রাখতে হবে, তার একটি পরামর্শ দেওয়া হয়।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল মাত্র ২৮০টি ভবনকে অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এগুলোর সবই অবশ্য শিল্পকারখানার জন্য।

রাজউক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বনানীর এফ আর টাওয়ারটির নকশার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ফলে এই ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু পরে অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনার অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। তারা সেটা করেনি। এ ব্যাপারে ভবন কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এফ আর টাওয়ারে অগ্নিপ্রতিরোধের ব্যবস্থা না থাকায় গত ডিসেম্বরে ভবন কর্তৃপক্ষকে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তারা আসেনি। এরপর জানুয়ারিতে নোটিশ দেওয়া হয়। এরপরও ভবন কর্তৃপক্ষ কিছু করেনি।

এর আগে ২০১৭ সালে ঢাকা মহানগরীতে মোট ৩ হাজার ৭৮৬টি বিপণিবিতান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, আবাসিক হোটেল পরিদর্শন করেছিল ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৯টি ভবনই ছিল অতি ঝুঁকিপূর্ণ। ২ হাজার ৫৮৮টি ভবন ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। এরপর প্রতিটি ভবন কর্তৃপক্ষকে অগ্নিপ্রতিরোধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নোটিশ দেওয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।

জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী আমাদের বিচারিক ক্ষমতা নেই, নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেটও নেই। তাই নোটিশ দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকে না। ভবনমালিক নোটিশ অনুযায়ী কাজ না করলে তা রাজউককেও জানানো হয়। এরপর রাজউককেই ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

অধিদপ্তরটির আরেক পরিচালক (অপারেশন ও মেনটেন্যান্স) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজের মতে, ভবনে ব্যবহার বা বসবাসের সনদ দেয় রাজউক। তাই কোনো ভবনে অগ্নিপ্রতিরোধের ব্যবস্থা আছে কি না, তা রাজউককেই দেখতে হবে।

কিন্তু রাজউক থেকে পাওয়া তথ্যে ভবনমালিকদের বসবাস বা ব্যবহার সনদ নেওয়ার খুবই হতাশাজনক চিত্র পাওয়া গেছে। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা মহানগরে প্রায় ৪০ হাজার ভবন তৈরি হয়েছে। অথচ বসবাস বা ব্যবহার সনদ নিয়েছে মাত্র ১৬২টি ভবন।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে রাজউক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, ‘এখন এ বিষয়ে কাজ করার সময় এসেছে। আমরা বহুতল ভবনে অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করব।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক ও নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খানের মতে, বসবাস বা ব্যবহার সনদ নেওয়া নিশ্চিত করতে পারলে বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের এমন ঝুঁকির সৃষ্টি হতো না। তিনি বলেন, এই সনদ পাঁচ বছর অন্তর নবায়ন করতে হয়। নবায়নের সময় ভবন নির্মাণের আগে জমা দেওয়া নকশা ও ভবনের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হয়। গরমিল পাওয়া গেলে বা অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকলে রাজউক সেই ভবন উচ্ছেদ কিংবা পুরো ভবনই পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে পারে। কিন্তু রাজউক আদৌ জননিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দেয় বলে মনে হয় না।