যেভাবে ৩৫০ টাকার গরুর মাংস ৫৫০!

>
  • এক কেজি গরুর মাংসের উৎপাদন ব্যয় ৩৫০ টাকা, বিক্রি ৫৫০ টাকা
  • মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ
  • ছয় বছরে গরুর মাংসের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে

সীমান্তে কড়াকড়ি, পথে পথে চাঁদাবাজি আর সরবরাহে ঘাটতি—এই তিনটি কারণ দেখিয়ে বেড়ে গেছে গরুর মাংসের দাম। দুই মাসে আগে এক কেজি গরুর মাংস ৪৮০ টাকায় মিললেও এক লাফে দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫০০ টাকায়। এক লাফে গরুর মাংসের দাম বাড়া নতুন কিছু নয়। বরাবরের মতো রমজান মাস আসার আগে তিনটি কারণ দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দেন এর বিক্রেতারা। ওপরের তিন অজুহাতে গত ছয় বছরে গরুর মাংসের দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।

মাংস বিক্রেতাদের দাবি, সরকারের নজরদারি ও পদক্ষেপের অভাবে গরুর মাংসের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। অন্যদিকে খামারিদের দাবি, একটি গরু লালনপালন করে কেজিপ্রতি মাংস উৎপাদনে খরচ হয় সাড়ে ৩০০ টাকা। তাই এক কেজি গরুর মাংসের দাম ৪০০ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, লাভের অঙ্ক কার কাছে যাচ্ছে? অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশের গরুর মাংসের বাজার এখন ভারতের ওপর নির্ভরশীল নয়। পাঁচ বছর আগেও এ দেশে গরুর মাংসের চাহিদার ৬০ শতাংশ চাহিদা মেটাত ভারতীয় গরু। কিন্তু এখন সেটি ৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোরবানির ঈদসহ দেশে সারা বছর মাংসের চাহিদা ৭ দশমিক ১৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন। সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ৭ দশমিক ২০ মিলিয়ন মেট্রিক টন। জনপ্রতি মাংসের চাহিদা প্রতিদিন ১২০ গ্রাম।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশে মাংসের চাহিদা ছিল ৬ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। তখন দেশে উৎপাদন হতো মাত্র ১ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাংস। আর সে সময় জবাই হতো ৬৭ লাখ ৩০ হাজার গবাদিপশু। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মাংসের চাহিদা বেড়ে হয় ৭ দশমিক ২০ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এ সময় দেশে মাংস উৎপাদন হয়েছে ৭ দশমিক ১৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, রমজান মাসে কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না, সরবরাহেও ঘাটতি থাকবে না। কিন্তু এরই মধ্যে দাম বাড়ছে। এখন রাস্তাঘাট ভালো আছে। পণ্য পরিবহনে কোনো সমস্যা নেই; যদিও ট্রাকভাড়া একটু বেশি। গরুর মাংসের দাম ৪২০ থেকে ৪৫০ টাকার বেশি কোনোভাবেই হতে পারে না।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন জানায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে ২০ লাখ গবাদিপশু আমদানি করতে হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই সংখ্যা কমে হয়েছে মাত্র ৫ লাখ।


এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা জানান, ভারত থেকে গরু আসা বন্ধের কারণে দেশে গরুসহ গবাদিপশুর অসংখ্য খামার গড়ে উঠেছে। এসব খামারের কারণে দেশীয় গরুর উৎপাদন বেড়ে গেছে। তাই মাংস ও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।

ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে সব খরচ মিলিয়ে এক কেজি গরুর মাংস উৎপাদন ব্যয় ৩৫০ টাকার বেশি হয় না। তাই বাজারে এর দাম ৪০০ থেকে ৪২০ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।

তবে বাংলাদেশ মাংস বিক্রেতা সমিতির মহাসচিব রবিউল আলমের মতে, নজরদারির অভাবে গরুর মাংসের দাম বাড়ছে। চাঁদাবাজির কারণে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে মাংস বিক্রেতাদের। সীমান্ত থেকে একটি গরু ঢাকায় আনতে চাঁদাসহ অন্যান্য খরচ হচ্ছে ৫০ হাজার টাকার বেশি। এ ছাড়া গাবতলীর পশুর হাটে ইজারাদার গরুপ্রতি ১০০ টাকা খাজনার বদলে দুই হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা বাড়তি আদায় করছেন।

দেশের খামারেই গরুর চাহিদা মেটে, এ কথা জানালে রবিউল আলম বলেন, ভারত থেকে কম গরু আসছে। তবে চাঁদাবাজির কারণে দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন মাংস বিক্রেতারা।

মাংসের দাম যেভাবে বেড়েছে
রমজান মাস শুরুর আগে মাংসের দাম নির্ধারণ করে থাকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। মাংস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে এই দাম নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত এই দাম অনুসরণ করেন ঢাকাসহ সারা দেশের মাংস বিক্রেতারা। এই সুযোগই কাজে লাগান তাঁরা। তাই বৈঠকের বেশ কয়েক মাস আগেই গরুর মাংসের দাম বাড়িয়ে দেন মাংস বিক্রেতারা।

২০১৩ সালের রমজান মাসের আগে প্রতি কেজি গরুর মাংস ছিল ২৫০ টাকা। কিন্তু হঠাৎ দাম বাড়ানো হয়। পরে মাংস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে সিটি করপোরেশন ওই বছর গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করে ২৭৫ টাকা।

একইভাবে ২০১৪ সালের রমজানে ২৮০ টাকা, ২০১৫ সালের শুরুতে ২৮০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায় প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হতো। কিন্তু ভারতের বিজেপি সরকার সীমান্ত দিয়ে গরু আনা বন্ধ করে দিয়েছে—এই কারণ দেখিয়ে গরুর মাংসের দাম উঠে যায় ৩৭০ টাকায়। এরপরই দেশে অসংখ্য গবাদিপশুর খামার গড়ে ওঠে।

ভারত থেকে গরু আসা বন্ধের কারণ দেখিয়ে ২০১৭ সালে রমজান মাসে গরুর মাংসের দাম আরও কয়েক দফা বাড়ান মাংস বিক্রেতারা। ওই বছর রমজানে সিটি করপোরেশন গরুর মাংসে দাম নির্ধারণ করে ৪২০ টাকা।

একই অজুহাতে ২০১৭ সালের রমজানে দেশি গরুর মাংস ৪৭৫ এবং ভারতীয় গরুর মাংসের দাম ৪৪০ টাকা হয়ে যায়। সবশেষ ২০১৮ সালের রমজানের আগে গরুর মাংসের দাম ৫০০ টাকা নির্ধারণের দাবি করেন মাংস বিক্রেতারা। তবে নানা কারণে গরুর মাংসের দাম ৪৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবুও গত রমজানের শুরুতে ৫০০ টাকায় মাংস বিক্রি করতে থাকেন বিক্রেতারা। এ সময় র‍্যাবসহ ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের কারণে ৪৫০ টাকায় বিক্রি করেন তাঁরা। তবে ২৫ রোজার পর দাম ৫০০ টাকার ওপরে নিয়ে যান মাংস বিক্রেতারা।

দাম অতিরিক্ত উঠে যাওয়ায় মাংস বিক্রি কমে যায়। তাই ২০১৮ সাল থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৮০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করত গরুর মাংস। কিন্তু বছর ঘুরে রমজান মাস আসার আগে গরুর মাংসের বর্তমান দাম ৫৫০ টাকা।

গাবতলীর পশুর হাটের ইজারাদার গরুপ্রতি অতিরিক্ত টাকা খাজনা আদায় করেছেন—এ কথা জানালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘মাংস বিক্রেতারা এ ধরনের কোনো অভিযোগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কাছে আসেননি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নিয়ে এলে অবশ্য আমরা ব্যবস্থা নেব। ৩৫০ টাকা যদি এক কেজি গরুর মাংসের উৎপাদন খরচ হয়ে থাকে, তাহলে ফায়দা নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। বিষয়টি মাননীয় মেয়রের নজরে আনাব।’