'এফ আর টাওয়ার নির্মাণে অনিয়মকারীদের ছাড়বে না দুদক'

দুদকের শ্রেষ্ঠ দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী, দুদক মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্য দিচ্ছেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। ছবি: প্রথম আলো।
দুদকের শ্রেষ্ঠ দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী, দুদক মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্য দিচ্ছেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। ছবি: প্রথম আলো।

বনানীর এফ আর টাওয়ার নির্মাণে অনিয়মকারীদের সবাই ছেড়ে দিলেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ছাড়বে না। এই ঘোষণা দিয়েছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। আজ রোববার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার অডিটোরিয়ামে এক অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে দুদক চেয়ারম্যান এ ঘোষণা দেন। দুদকের শ্রেষ্ঠ দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী, দুদক মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠান ও সততা সংঘের সমাবেশ উপলক্ষে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। 

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘কেন যেন মনে হয় অনিয়মকে সবাই নিয়মে পরিণত করছে। বনানীর এই বিয়োগান্ত ঘটনা এসব অনিয়মের পরিণতি।’ এ জাতীয় অনিয়মকে দুর্নীতি অবহিত করে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘সময়মতো কাজ করবেন না, এটাও দুর্নীতি । ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনেক আগেই কাজ শুরু হয়েছে, এবার এসব অনিয়ম বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ শুরু হবে।’ ১৮ তলা ভবনের অনুমোদন পেলেন, বানালেন ২২ তলা। এই অনিয়মের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের ক্ষমা হবে না। এভাবে জনগণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা আর সহ্য করা ঠিক হবে না।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘এখন দুর্নীতির মাত্রা কমছে কি না, প্রশ্ন আছে। আশা করি কমছে।’ তবে রাজনীতি বা অর্থবিত্তের কাছে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান যাতে চাপা না পড়ে, সে বিষয়ে নজর দিতে দুদকের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘শিক্ষার ক্ষেত্রে সবাই জিপিএ-ফাইভের দিকে ছুটছে। কিন্তু শুধু জিপিএ-ফাইভের মাধ্যমে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অর্জন করা যাবে না। দুদক শ্রেণিকক্ষের ভেতরে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। সে জন্য শিক্ষা আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে দুদককে ধন্যবাদ জানাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ কথা স্বীকার করতেই হবে, দুদক যদি কোচিংবাজ শিক্ষকদের তালিকা প্রণয়ন না করত, তাহলে হয়তো কোচিং-বিরোধী নীতিমালা আইনি বৈধতা পেত না।’

দুদকের শ্রেষ্ঠ দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী, দুদক মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। ছবি: প্রথম আলো।
দুদকের শ্রেষ্ঠ দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী, দুদক মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। ছবি: প্রথম আলো।

রাশেদা চৌধুরী মন্তব্য করেন, ‘সততা সংঘ ও সততা স্টোর পরিচালনা দুদকের একার কাজ না। এটা আমাদের সবার কাজ। এ ক্ষেত্রে মিডিয়া, সুশীল সমাজসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সমন্বিতভাবেই দুর্নীতিবিরোধী চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে।’
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উদাহরণ দিয়ে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি সিলেটের একজন মেয়ে শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তার বাবা তাকে ঈদ উপলক্ষে ১৫ হাজার টাকার লেহেঙ্গা কিনে দেন। সে তার বাবার বেতনাদি সম্পর্কেও জানত। সেই মেয়ে প্রকাশ্যেই তার বাবার কাছে জানতে চেয়েছিল, এটা কি দুর্নীতি না? পরের কোরবানির ঈদে ওই মেয়েটি তার বাবার দামি উপহার গ্রহণ করেনি। সেই তার বাবাকে দুর্নীতিমুক্ত করার চেষ্টা করছে।
তিনি দুদকের প্রশংসা করে বলেন, ‘দুদক নতুন প্রজন্মকে নিয়ে কাজ শুরু করেছে। অনেকেই বলেন ব্যাংক লুটপাট নিয়ে দুদক কাজ করুক। আমি বলব এ কাজ দুদক করবে। আগামী দিনে যারা ব্যাংক চালাবে, তাদের নিয়ে যে কাজ করছে এটা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।’

সভাপতির বক্তব্যে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুদক কাজ করছে। তবে এ কথাও ঠিক কমিশনের একার পক্ষে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক কাজই করতে পারি না। কেন পারি না? এর উত্তর দেওয়া কঠিন, কারণ আমরা একটি গণ্ডির মধ্যে কাজ করি। কমিশনের অভিযোগ কেন্দ্রের হটলাইন-১০৬ এ লাখ লাখ ফোন কল এসেছে। এর সামান্যসংখ্যক অভিযোগই আমলে নেওয়া হয়েছে। আর যেসব অভিযোগ কমিশন আইনের আওতায় নেই, সে বিষয়েও আমরা সঠিক পরামর্শ প্রদান করেছি।’
দুদকের হটলাইন এখন জনগণের অভিযোগ জানানোর এক বিশ্বস্ত প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখানে আসা অভিযোগের ভিত্তিতেই কমিশনের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের মাধ্যমে দেশব্যাপী তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অধিকাংশ অভিযানই সফল হচ্ছে এবং দুর্নীতি ঘটার আগেই তা প্রতিরোধ করা যাচ্ছে। মূলত ১০৬ হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধের অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার আগেই তা প্রতিরোধ করা হচ্ছে।’
দুর্নীতিবাজদের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘যাঁরা সরকারি সম্পদ অবৈধভাবে দখল করে ভোগদখল করছেন, নদী দখল করেছেন, লুটপাট করে সম্পত্তি গ্রাস করেছেন, এই সব জনগণের সম্পত্তি ত্যাগ করুন, নইলে আপনাদের জন্য কঠোর পরিণতি অপেক্ষা করছে।’
ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ ,বাংলাদেশ রেলওয়ে কিংবা বন বিভাগের সম্পত্তি দখল করে অনেকে রেস্ট হাউস বানিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী সরকারের সম্পত্তি সরকারের নিকট সমর্পণ করুন। নইলে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে। যাঁরা অনিয়মের মাধ্যমে জনগণের অর্থ নিয়েছেন অথবা যাঁরা অর্থ দিয়েছেন, এসব অর্থ লোপাটকারীদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।’
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে শিক্ষকদের উদ্দেশে ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘আপনারা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জিম্মাদার, আপনারা আমাদের জিম্মি করবেন না। কোচিং-বাণিজ্য ও নোট-বাণিজ্য থেকে আমাদের শিক্ষাকে মুক্ত করুন। আমাদের নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি গঠনে আপনারা কার্যকর ভূমিকা রাখুন।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত, দুদক মিডিয়া জুরি বোর্ডের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, বিতার্কিক আলিফ আল জামাল, সততা সংঘের সদস্য সঞ্চিতা রহমান মিম, নেত্রকোনা জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আমজাদ খান, সাভার উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. সালাউদ্দীন নাঈম প্রমুখ।
এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান ও এ এফ এম আমিনুল ইসলাম।

এবারও দুই ক্যাটাগরিতে সাংবাদিকদের দুদক মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। প্রিন্ট ক্যাটাগরিতে প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ফখরুল ইসলাম হারুণ এবং দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছেন দৈনিক ‘সমকাল’-এর বিশেষ প্রতিনিধি হকিকত জাহান হকি। ইলেকট্রনিক মিডিয়া ক্যাটাগরিতে প্রথম হয়েছেন মাছরাঙা টিভির বিশেষ প্রতিনিধি বদরুদ্দোজা বাবু এবং দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছেন ৭১ টিভির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক পারভেজ নাদির রেজা। বিজয়ীরা প্রথম পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন নগদ ৫০ হাজার টাকা, ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট এবং ২য় পুরস্কার বিজয়ীরা পেয়েছেন নগদ ৪০ হাজার টাকা, ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট।

দুদকের চেয়ারম্যান, দুই কমিশনার, সচিব ও অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির সঙ্গে দুদক মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী তিন সাংবাদিক। ছবি: প্রথম আলো
দুদকের চেয়ারম্যান, দুই কমিশনার, সচিব ও অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির সঙ্গে দুদক মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী তিন সাংবাদিক। ছবি: প্রথম আলো