পাহাড়ের কোলে গোছানো ক্যাম্পাস

শিক্ষার্থীদের পদচারণ মুখর আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের কুমিরা ক্যাম্পাস। গত রোববার দুপুরে।  প্রথম আলো
শিক্ষার্থীদের পদচারণ মুখর আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের কুমিরা ক্যাম্পাস। গত রোববার দুপুরে। প্রথম আলো

তিন দিকে সবুজ পাহাড়। একদিকে সাগর। এরই মধ্যে ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের আঁকাবাঁকা রাস্তার পাশে ফুলের বাগান। শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে সারাক্ষণ। মুগ্ধ করা এই পরিবেশ আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম (আইআইইউসি) ক্যাম্পাসের।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরায় ৪৩ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এটি দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ঘোড়ামরা এলাকা থেকে পূর্ব দিকে ১৫০ মিটার গেলেই বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাস।

দেশের পাশাপাশি বিদেশি শিক্ষার্থীরাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন উচ্চশিক্ষার জন্য। এখান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক কোম্পানি, টেলিকম সেকশন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। অনেকে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে পিএইচডি করে চাকরি নিয়েছেন।

গত রোববার দুপুরে ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা গাছের ছায়ায় বসে দলগত কাজ করছেন, কেউবা গ্রন্থাগারে পড়াশোনা করছেন। পরীক্ষা শেষে হল থেকে বের হয়ে আসছিলেন অনেকে। ক্যাম্পাসজুড়ে রয়েছে ওয়াই–ফাই সুবিধা।

কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল নাহিয়ানের সঙ্গে। তিনি প্রথম সেমিস্টারের একটি পরীক্ষা দিয়ে বের হন। তিনি বলেন, যান্ত্রিক কোলাহলমুক্ত পরিবেশবান্ধব পরিবেশে তাঁরা পড়াশোনা করছেন। ক্যাম্পাসে আসার পর তাঁদের খুবই ভালো লাগে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের স্বনামধন্য কয়েকজন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে জ্ঞানের সঙ্গে নৈতিকতার সমন্বয় ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশাত্মবোধ, মানবতাবোধ, সততা ও বিজ্ঞানমনস্কতা সৃষ্টি করা।

প্রথম দিকে কুমিরায় নিজস্ব ক্যাম্পাসের পাশাপাশি ঢাকা ও চট্টগ্রামে আরও দুটি ক্যাম্পাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হতো। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ক্যাম্পাস বন্ধ করে এখন শুধুমাত্র সীতাকুণ্ডের কুমিরায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে পাঠদান চলছে।

৪৩ একর ভূমির ওপর বিশাল এ ক্যাম্পাস। যেখানে রয়েছে ৪০টি ভবন। নির্মাণাধীন রয়েছে ছয়টি ভবন। আছে খেলার মাঠ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের জন্য রয়েছে ৫৩ গাড়ি। রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ অত্যাধুনিক কম্পিউটার ল্যাব, ইন্টারনেট ল্যাব, ৫৫৫ এমবিপিএস ইন্টারনেট সুবিধা।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ছয়টি অনুষদের অধীনে ১১টি বিভাগ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে কোরআনিক সায়েন্স অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রনিক অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং ও ফার্মেসি, ব্যবসায় প্রশাসন, অর্থনীতি ও ব্যাংকিং, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য ও আইন বিভাগ।­

­­বসন্তকালীন সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে এবং শরৎকালীন সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের জুলাই-আগস্ট মাসে ভর্তি করানো হয়। দুটি সেমিস্টারে যথাক্রমে মার্চ ও সেপ্টেম্বরে ক্লাস শুরু হয়।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজারের মতো। এর মধ্যে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, চীন, সোমালিয়া, মালদ্বীপ, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া ও সুদানের শতাধিক বিদেশি ছাত্র অধ্যয়ন করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। যেখানে রয়েছে মোট ৮৫ হাজার বই। স্থাপত্যশৈলীর নান্দনিক সৌন্দর্যের একটি তিনতলা ভবন নিয়ে গ্রন্থাগার। যেখানে ৪০৫ শিক্ষার্থী একসঙ্গে বসে তাঁদের পাঠ অনুশীলন করতে পারেন। এখানে একজন শিক্ষার্থী চারটি বই সর্বোচ্চ ৪৫ দিন রেখে পড়াশোনা করতে পারেন। রয়েছে সমৃদ্ধ অনলাইন গ্রন্থাগার।

উচ্চশিক্ষায় ইচ্ছুক দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিবছর দরিদ্র মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার আর্থিক সুবিধা এবং বৃত্তি প্রদান করা হয়।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, নেপাল, তুরস্ক, সুদানসহ বিশ্বের ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমঝোতা স্মারক রয়েছে।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র মো. সানাউল্ল্যাহ চৌধুরী এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মানের পড়াশোনা হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিশ্ববিদ্যায়ের প্রাক্তন কয়েকজন শিক্ষার্থী জাপান, কোরিয়া ও আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। দেশের বিভিন্ন কোম্পানিতে ঊর্ধ্বতন পদে চাকরি করছেন অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কে এম গোলাম মহিউদ্দিন বলেন, ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন স্বল্পতা আছে। তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ উচ্চশিক্ষার দ্বার খুলে দিয়েছে। ফলে অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভের সুযোগ পাচ্ছেন।

আন্তর্জাতিক মানের পাঠদান দেওয়া হয় উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, এ ক্ষেত্রে ইউজিসির নির্দেশনা পালন করা হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ৩২ হাজার ১১৭ জন গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। তাঁরা দেশের সরকারি ছাড়াও স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন।

প্রতিষ্ঠানটি সেশনজট ও রাজনীতিমুক্ত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলে জানান উপাচার্য। এতে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত সময়েই কোর্স সম্পন্ন করতে পারছেন। তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ও নৈতিকতার সমন্বয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। দেশের আন্তবিশ্ববিদ্যালয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ সহপাঠক্রমে অংশগ্রহণ করেন শিক্ষার্থীরা। নেই শিক্ষক স্বল্পতা। রয়েছে যাতায়াতসহ শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত সুবিধা।

এ ছাড়া সবুজায়নের জন্য ২০১২ ও ২০১৫ সালে সারা দেশে বৃক্ষরোপণে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাটাগরিতে আইআইইউসি প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার লাভ করে।