উন্মুক্ত হলো দেয়ালের আড়ালে থাকা প্রান্তর

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কৃষি গবেষণা মাঠ এত দিন বাইরের মানুষের দৃষ্টির আড়ালে ছিল। সম্প্রতি আগারগাঁওয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কৃষি গবেষণা মাঠ এত দিন বাইরের মানুষের দৃষ্টির আড়ালে ছিল। সম্প্রতি আগারগাঁওয়ে। ছবি: প্রথম আলো

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে থেকে মিরপুর রোডে যাওয়ার সংযোগ সড়কের ডান পাশে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মাঠ। ১৬ একরের এই মাঠে বছরভর ফল-ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নতিকরণের কাজ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এতে মৌসুমভেদে মাঠটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যে পসরা সাজিয়ে বসে, তা নিরেট দেয়ালের কারণে উপভোগের কোনো সুযোগ বাইরের মানুষের ছিল না। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ওই দেয়াল উঠিয়ে সেখানে গ্রিলের বেষ্টনী বসানো হয়েছে। এতে পথচলতি মানুষের চোখের সামনে ঠাসবুনটের এই নগরে হাজির হচ্ছে বিস্তীর্ণ ফসলি প্রান্তর।

এই পথে নিয়মিত চলাচলকারী যাত্রী ও পথচারীদের ভাষ্য, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মাঠ লাগোয়া সংযোগ সড়কটি এখন রাজধানীর সুন্দরতম রাস্তাগুলোর একটি। সড়কের এক পাশে বাণিজ্য মেলার বিশাল আয়তনের মাঠ ও চন্দ্রিমা উদ্যানের একরাশ সবুজ। অন্যপাশে চোখে পড়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে নানা প্রজাতির গাছগাছালি শোভিত প্রাকৃতিক দৃশ্য। ঢাকায় এমন বিশাল উন্মুক্ত জায়গার দেখা পাওয়া দুষ্কর। এতে চোখের আরামের সঙ্গে মনের প্রশান্তিও তৈরি হয়। কয়েকজন বলেন, দেয়ালের ওপারে এই মাঠ ও কৃষি বিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশের ব্যাপারে তাঁদের কোনো ধারণাই ছিল না। দেয়াল উঠিয়ে দেওয়ার ফলে সেই সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ হচ্ছে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও কাজটি বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কর্মকর্তারা বলছেন, দুই বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দেয়াল সরানোর এই উদ্যোগ নেন তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক। তিনি ঢাকার দেয়ালগুলো যথাসম্ভব উন্মুক্ত রাখার পক্ষে ছিলেন। যাতে দেয়ালঘেরা স্থাপনার এই শহরে অন্তত চোখের আরামটুকু পেতে পারে নগরবাসী।

দেয়াল অপসারণ করে সেখানে গ্রিলের বেষ্টনী বসানোর কাজটি করা হয়েছে কয়েক ধাপে। কাজটি শুরু হয় গত বছরের এপ্রিল মাসে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা শেষ হয়েছে। এখন চলছে অলংকরণের কাজ।

সম্প্রতি দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ প্রান্তে মাঠঘেঁষা পুরোনো দেয়ালটি পুরোটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অবশ্য নতুন করে বসানো গ্রিলের বেষ্টনীর নিচের অংশে অন্তত ২ ফুট উচ্চতার জায়গায় কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া। অবশ্য তাতে সড়ক কিংবা মাঠ থেকে ভেতর-বাইরের দৃশ্য দেখার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে না। সব মিলিয়ে জায়গাটির সৌন্দর্য আলাদা মাত্রা পেয়েছে।

এ বিষয়ে কথা হয় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কামাল উদ্দিন আহাম্মদের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘দেয়ালে দেয়ালে আমরা নিজেরাই শহরটাকে ছোট করে ফেলছি। এ ক্ষেত্রে নিরেট দেয়ালহীন কোনো স্থাপনা কেমন হতে পারে, তার একটা উদাহরণ তৈরি করতে চাচ্ছিলাম আমরা। মেয়র আনিসুল হক এ ব্যাপারে আমাদের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এরপর আমরা নিজেরাই একটা নকশা তৈরি করে সিটি করপোরেশনকে দিই। পরে তারা সেটা বাস্তবায়ন করে।’ তাঁর অভিমত, শহরের অন্যান্য বড় ভবন কিংবা স্থাপনাগুলোতেও বায়ু চলাচল করতে পারে, এমন স্বচ্ছ বেষ্টনী বসানো যেতে পারে। পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য এটা ভালো। পাশাপাশি এই বিচ্ছিন্নতার নগরে বাসিন্দাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র স্থাপনেও এটা সহায়ক হতে পারে।

এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার বিভাগের অধ্যাপক আ ফ ম জামাল উদ্দীন। তিনি বলেন, শুরুর দিকে বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী ইতিবাচকভাবে নেননি। তাঁদের ধারণা ছিল দেয়াল উঠিয়ে দিলে সড়কের ধুলা আর যানবাহনের ধোঁয়ায় মাঠের ফুল-ফসলের ক্ষতি হবে। কিন্তু কাজটি শেষ হওয়ার পর তাঁদের এই ধারণা বদলেছে। আর বাইরের অনেকের কাছে এর মধ্যেই এই এলাকাটি পছন্দের বেড়ানোর জায়গায় পরিণত হয়েছে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের পাশের নিরেট দেয়াল ভেঙে বসানো হয়েছে গ্রিল। এতে ভেতরের সবুজ এখন পথচলতি মানুষের চোখে পড়বে।  ছবি: প্রথম আলো
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের পাশের নিরেট দেয়াল ভেঙে বসানো হয়েছে গ্রিল। এতে ভেতরের সবুজ এখন পথচলতি মানুষের চোখে পড়বে। ছবি: প্রথম আলো

এদিকে ঢাকার পার্ক কিংবা মাঠগুলোতে স্বচ্ছ সীমানাবেষ্টনী তৈরির একটা ধারা এর মধ্যেই তৈরি হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন খেলার মাঠ ও পার্ক উন্নয়নে আলাদা দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই দুই প্রকল্পের নকশাকারেরা অধিকাংশ পার্ক ও মাঠের পুরোনো নিরেট দেয়াল তুলে দিয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ‘জল সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের আওতায় স্থপতি রফিক আজম এমন কিছু পার্কের নকশা করেছেন, যার কোনো সীমানাবেষ্টনীই নেই। তাঁর কাছে দেয়াল মানে অবিশ্বাস, যা পরস্পরের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে।

একইভাবে স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৭টি পার্ক ও ৪টি খেলার মাঠের নকশায় ব্যবহার করছে লোহার জালির সীমানাবেষ্টনী। যাতে ওপার-ওপার পুরোটাই দেখা যায়। এ বিষয়ে ভিত্তি স্থপতিবৃন্দের পরিচালক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার এ রকম কয়েকটি দেয়াল সরিয়ে নিতে পারলে শহরটাকে খানিকটা হলেও উন্মুক্ত মনে হবে। মেয়র আনিসুল হক বেঁচে থাকতে তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরের দেয়াল তুলে সেখানে স্বচ্ছ সীমানাবেষ্টনী বসানোর একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে অনুসারে এর নকশাও তৈরি করা হয়েছিল। এটা যদি বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে তা হবে ঢাকাবাসীর জন্য চমৎকার একটা উপহার।

এই দুই স্থপতির মতে, দেয়াল কখনো মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারে না। বরং এসব দেয়ালই সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের আড়াল হয়ে ওঠে।