'মামলা ড্যা কবে শেষ হবি?'

প্রতিবন্ধী সন্তানের পাশে মাহফুজা বেগম।  প্রথম আলো
প্রতিবন্ধী সন্তানের পাশে মাহফুজা বেগম। প্রথম আলো
>

• খাসজমিতে প্রায় ৪০ বছর ধরে বাস করছেন মাহফুজা বেওয়া
• জমিটুকু কেড়ে নিতেই মামলা করেছিলেন এক জোতদার
• বাদী মারা গেছেন
• মামলা চলছে একযুগ ধরে

খড়ের ভাঙা ঘরে মাটির বারান্দায় পেতে দেওয়া পাটিতে পড়ে আছে নিথর এক মানবদেহ। দুই পা, দুই হাত কোঁকড়ানো। শুধু বড় বড় আবেগময় দুটি চোখ দেখে বোঝা যায়, ওই দেহে প্রাণ আছে। কথা বলার বা ইশারা করার সামর্থ্য নেই। তবে মুখে তরল খাবার তুলে দিলে খেতে পারেন। চাহনি দেখে শুধু তাঁর মা বুঝতে পারেন ছেলের কখন কী প্রয়োজন। মা–ই তাঁর জগৎ।

কিন্তু যে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন ছেলেটি, সেই মায়েরই তো কোনো সহায় নেই। স্বামী মারা গেছেন অনেক আগেই। আরেকটি ছেলে থেকেও না থাকার মতো। সেই ছেলে মাদকাসক্ত হয়ে বেকার ঘুরে বেড়ায়। ভূমিহীন এই মা সারা দিন পদ্মার চর থেকে ঘাস তুলে বাজারে বিক্রি করে দুমুঠো খাবারের জোগাড় করেন। তাতেও তাঁর দুঃখ ছিল না। কিন্তু সমস্যা হয়েছে, যে খাসজমিতে তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে বাস করছেন, সেই জমিটুকু কেড়ে নিতেই মামলা করেছিলেন এক জোতদার। এক যুগ ধরে সেই মামলা চলছে। এরই মধ্যে বাদী মারা গেছেন। কিন্তু শুনানি চলছেই। তাই এখনো আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন এ অসহায় নারী।

এটা কোনো গল্প না, এটা নাটোরের লালপুর উপজেলার বিলমাড়িয়া ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের বিধবা মাহফুজা বেওয়ার জীবন।

গত ৩০ মার্চ দুপুরে মাহফুজা বেওয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি মাঠ থেকে তুলে আনা ঘাস (গো খাদ্য) আঁটি করছেন বাজারে বিক্রি করতে যাওয়ার জন্য। বাড়ির ভিটায় দুটি কাঁচা ঘর। পূর্বদুয়ারী ঘরের বারান্দায় খেজুর পাতার পাটিতে শুয়ে আছেন বড় ছেলে সুমন। মায়ের হিসাবমতে তাঁর বয়স ১৯ বছর। ডাকাডাকি কিংবা ইশারায় অনেক চেষ্টা করেও তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেল না। একটা চাদর দিয়ে শরীরটা ঢাকা। নিথর শরীরটি দেখে বোঝা গেল, তাতে কোনো অনুভূতি নেই। তেলমাখা কুচকুচে কালো চুলের নিচে গভীর দুটি চোখ দেখে বোঝা গেল, তিনি বেঁচে আছেন।

মাহফুজা বেগম জানান, ছেলে কথাও বলতে পারেন না। কানেও শোনেন না। মুখে তরল খাবার তুলে দিলে তা গিলে নেন। প্রস্রাব-পায়খানা–গোসল সবই হয় ওই বিছানাতেই। ছেলের চোখ দেখে একমাত্র তিনিই বুঝতে পারেন তাঁর কখন কী প্রয়োজন। তাই তাঁকে ছাড়া তাঁর ছেলে অচল। তবুও জীবিকার তাগিদে তাঁকে ছেলেকে রেখে হাটে-মাঠে যেতে হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাঠে ঘাস তোলেন। পরে তা বাড়িতে এনে বিকেলে বাজারে নেন বিক্রি করতে। সেই টাকা দিয়েই চলে সংসার।

মাহফুজা বেগম জানান, অভাব–অনটনের মধ্যেই তিনি বড় হয়েছেন। তাই এগুলো তাঁর গা সওয়া। কিন্তু এখন ভিটেমাটি রক্ষা করাটাই তাঁর বড় কষ্ট। বাড়ির ভিটাসহ রসুলপুর মৌজার ৭৭ শতাংশ খাস জমি ৪০ বছর যাবৎ তাঁরা ভোগদখল করে আসছেন। কিন্তু স্থানীয় এক জোতদার নিজেকে ভূমিহীন পরিচয় দিয়ে ওই জমি জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে তাঁর নামে কবুলিয়ত দলিল করিয়ে নিয়েছেন। ২০০৭ সালে তাঁর স্বামী জান্নাত আলী ওই দলিল বাতিল চেয়ে নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) আদালতে মামলা করেন। ২০০৯ সালে আদালত কবুলিয়ত দলিল বাতিল করে ওই জমি মাহফুজা ও তাঁর স্বামীর নামে বন্দোবস্ত দেন। এরই মধ্যে জান্নাত আলী মারা গেলে সেই জোতদার অসহায় মাহফুজাকে উচ্ছেদের জন্য লালপুর সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন। কিন্তু মামলায় মাহফুজাই ডিক্রি পান। এ ছাড়া জেলার কৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত কমিটি ২০১৭ সালে ওই জমি মাহফুজার নামে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়। তার পরও দমেননি ওই ব্যক্তি। মামলা চালিয়ে যেতে থাকেন। একসময় তিনি মারা যান। এরপর তাঁর ওয়ারিশরা কেউ আর ওই মামলায় জড়াননি। বিষয়টি আদালতকে জানান মাহফুজা। কিন্তু চূড়ান্ত শুনানি না হওয়ায় মামলাটি এখনো উচ্চ আদালতের সিভিল রিভিশন ডিভিশনে সচল রয়েছে।

মাহফুজা জানান, একদিকে বাড়িতে প্রতিবন্ধী শয্যাশায়ী সন্তান। অন্যদিকে ভিটেমাটি রক্ষায় ১২ বছর ধরে আদালতে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে তিনি ক্লান্ত ও নিঃস্ব। গত বুধবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা ড্যা কবে শেষ হবি? কবে আমি ছ্যালিডার পাশে একটু আরাম করি বসবো? মামলার পেছনে দুড়াতে দুড়াতে আমার সব শেষ। আমার ছ্যালিডার চিকিৎসাও করাতে পারিনি। আমি এ মামলা থ্যাকি মুক্তি চাই।’