গম ছেড়ে তামাক চাষে ঝুঁকছেন কৃষক

.
.

রংপুরের তারাগঞ্জের কৃষকেরা গম চাষ কমিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা ঝুঁকছেন তামাক চাষে। লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকেরা তামাক চাষ করছেন। এতে গম চাষ কমলেও বাড়ছে তামাক চাষ। তবে তামাক কাটা ও শুকানোর কাজে শিশুদের ব্যবহার করায় তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। শিশুরা হাঁপানিসহ ক্যানসারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।

তামাক চাষ বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অশোক কুমার রায় বলেন, গম চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে পরামর্শ। আইন না থাকায় তামাক চাষ বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। তবে তামাক চাষের কুফল বিভিন্ন সভায় তুলে ধরে এ ফসল চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু ফল পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য ফসলের তুলনায় লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকেরা তামাক চাষে ঝুঁকছেন।

উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, তারাগঞ্জে ৯ হাজার ৯৬৫ হেক্টর আবাদি জমি আছে। এর মধ্যে গম চাষের উপযোগী জমি প্রায় ৩ হাজার হেক্টর। উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বিশ্বনাথ সরকার বলেন, ২০১৪ সালে ৩৩২ হেক্টর, ২০১৫ সালে ৩২০ হেক্টর, ২০১৬ সালে ৩১২ হেক্টর, ২০১৭ সালে ২৯৫ হেক্টর ও ২০১৮ সালে ২১০ হেক্টরে গম চাষ করা হয়। উপজেলার তিন হাজার হেক্টর জমি গম চাষের জন্য উপযোগী হলেও কৃষি বিভাগ প্রতিবছর গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা কম নির্ধারণ করছে। লক্ষ্যমাত্রা ক্রমে কম করার কারণ হিসেবে কৃষক ও কৃষি বিভাগ বলছে, শ্রমিক–সংকট, ভালো বীজের অভাব ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে গম চাষে কৃষকেরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। গমের চেয়ে তামাক চাষে লাভ বেশি হওয়ায় তাঁরা তামাক চাষে ঝুঁকছেন। এ কারণে দিন দিন তামাক চাষ বাড়ছে। ২০১৪ সালে ৬৮০ হেক্টর, ২০১৫ সালে ৭৬০ হেক্টর, ২০১৬ সালে ৮১০ হেক্টর, ২০১৭ সালে ৮৯০ হেক্টর, ২০১৮ সালে ৯৫০ হেক্টর, ২০১৯ সালে ১ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। গমের পরির্বতে তামাক চাষ করে প্রতি হেক্টরে কৃষকেরা এক লাখ টাকা বেশি লাভ করছেন।

মেনানগর গ্রামের কৃষক ফজলুর রহমান বলেন, ‘বাবা তামাক আবাদ না করি করমো কী? হামার পেকে তো কায়ও দেখে না। সবজি-ধানের ভালো দাম পাই না। খালি লস। গম চাষেও পোষায় না। গম কাটার সময় শ্রমিক পাওয়া যায় না। তামাক চাষ করলে শ্রমিকের সমস্যা হয় না। স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে চাষ করা যায়। আট বছরের শিশুরাও তামাকের কাজ করির পায়। কোম্পানির লোকজন বীজ দেয়, সার দেয়, পরামর্শ দেয়। ফির (আবার) এক শ টাকা কেজি দরে তামাক কিনিও নেয়। ২৫০ শতক জমির তামাক বেচে গমের চেয়ে দেড় লাখ টাকা বেশি লাভ হয়। এই জন্যে তামাক আবাদ করুছি।’

পারঘাট গ্রামের কৃষক যতীন চন্দ্র বলেন, প্রতিবছর এক থেকে সোয়া বিঘা জমিতে তিনি গম চাষ করেন, যা সংসারের চাহিদা মেটায়। বাড়তি আয় করার জন্য গম চাষ না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আবহাওয়া ও ভালো বীজের অভাবেই গম চাষ থেকে সরে এসেছি। গমের চেয়ে পরিশ্রম কম, লাভ বেশি হওয়ায় তামাক চাষ করছি।’

দীঘলটারী গ্রামের কৃষক আবদুর রহমান প্রতিবছর গম চাষ করেন। কিন্তু এবার ভালো গমের বীজ না পাওয়ায় জমিতে গম চাষ করেননি। তবে বিনা মূল্যে বীজ পাওয়ায় এবং মুনাফা বেশি হওয়ার আশায় তিনি তাঁর এক একর জমিতে তামাক চাষ করেছেন।

নারায়ণজন গ্রামের কৃষক সাইবুল ইসলাম বলেন, গম চাষ করলে গম কাটার শ্রমিক পাওয়া যায় না। লাভও তেমন হয় না। গমের চেয়ে প্রতি হেক্টরে তামাক চাষ করলে দেড় লাখ টাকা বেশি লাভ হয়। তিনি আরও বলেন, ‘কোম্পানির লোকজন জমিত দাঁড়ে (দাঁড়িয়ে) থাকি তামাক আবাদ করি দেয়। ফির (আবার) বেশি দাম দিয়া ওরা কিনিও নেয়। কোনো ঝুঁকিটুকি নাই। ওই জন্যে তামাক আবাদ করুছি।’

বরাতি গ্রামের কৃষক তোফায়েল হোসেন বলেন, ‘সরকার তো জমির কাগজ ছাড়া হামাক ঋণ দেয় না। ব্যাংককোত গেইলে খালি দালাল। তামাউক আবাদ করতে এক পাইশা হামার নাগোচে না। টাকা, সার, বীজ ওষুধ সউগ ওমার (ওদের) আর আবাদ হামার; এইংক্যা সুযুগ (সুযোগ) কাঁয় ছাড়ে। সেই জন্যে এইবার গম না নাগেয়া দুই একর মাটিত তামাউক নাগাইচি।’

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন বলেন, তামাকজত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কৃষকদের বিনা মূল্যে তামাকের বীজ দেন। এ ছাড়া সার দেন, অনেক সময় ঋণও দেন। বিনা পুঁজিতে লাভ বেশি পাওয়ায় কৃষকেরা তামাক চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। এ কারণে এ উপজেলায় গম উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।

তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোস্তফা জামান চৌধুরী বলেন, সচেতনতার অভাবে মানুষ তামাক চাষ করছে। তামাক চাষে লাভ বেশি হলেও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। মানুষও নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুদের তামাক কাটা ও শুকানোর কাজে ব্যবহার করা হলে তাদের শ্বাসতন্ত্রে প্রদাহ, হাঁপানি ও ফুসফুসে ক্যানসারের মতো জটিল রোগ হতে পারে।