তবুও পরীক্ষা দিচ্ছেন অদম্য তানিয়া

কবজি দিয়ে লিখছেন তানিয়া। ফুলবাড়ী মহিলা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে। প্রথম আলো
কবজি দিয়ে লিখছেন তানিয়া। ফুলবাড়ী মহিলা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে। প্রথম আলো

তানিয়া খাতুনের দুটি হাতে একটি আঙুলও নেই। দুই হাতের কবজি দিয়ে কলম ধরে লিখে তিনি এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। তিনি ফুলবাড়ী মহিলা ডিগ্রি কলেজের ছাত্রী। ওই কলেজ কেন্দ্রেই মানবিক বিভাগের পরীক্ষার্থী তিনি।

গতকাল শনিবার ওই পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, তানিয়া দুই হাতের কবজি দিয়ে কলম চেপে ধরে লিখে চলেছেন, হাতের লেখাও সুন্দর। কোনো দিকে নজর নেই তাঁর। পরীক্ষা কেমন হচ্ছে, জানতে চাইলে মাথা তুলে ঝটপট উত্তর দেন, ‘খুব ভালো হচ্ছে।’ আগের দুটি বিষয়ের পরীক্ষাও ভালো হয়েছে বলে জানান তিনি।

কক্ষ পরিদর্শক প্রভাষক আলতাফ হোসেন ও সাহাজাদী খাতুন বলেন, ‘প্রথম দিন ওকে দেখে অবাক হয়েছি। কীভাবে ও পরীক্ষা দেবে, তা নিয়ে কৌতূহল হয়। খাতা ও প্রশ্ন দেওয়ার পর দেখলাম দিব্যি লিখে চলেছে। হাতের লেখাও সুন্দর।’

শিক্ষকেরা আরও জানান, প্রতিবন্ধীদের জন্য বাড়তি ২০ মিনিট সময় দেওয়া হয়। তানিয়া সে সুযোগ গ্রহণ করেননি। অন্যান্য পরীক্ষার্থীর সঙ্গে খাতা জমা দিয়ে চলে যান তিনি। তানিয়ার বাড়ি ফুলবাড়ী উপজেলার নাগদাহ গ্রামে। তাঁর বাবা তোফাজ্জল হোসেন বিমা কোম্পানিতে চাকরি করেন। মা মরজিনা বেগম গৃহিণী। তাঁরা এক ভাই, এক বোন। তানিয়া বড়। ছয় শতক জমির ওপর বসতভিটা ছাড়া তাঁদের আর কোনো সম্পদ নেই। তানিয়া জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী।

তানিয়া বলেন, ‘ছোটবেলায় দেখতাম পাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। ওদের সঙ্গে স্কুলে যেতে চাইলে মা বলেন, তোর হাত নেই, কেমন করে লেখাপড়া করবি। বাড়িতে বসে মাটিতে অ, আ, ক, খ লেখা শিখি। মা-বাবাকে বলি স্কুলে যাব। তারা কিছুতেই রাজি হন না। পরে আমার ইচ্ছায় তাঁরা স্কুলে ভর্তি করে দেন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি।’

২০১৭ সালে পূর্ব চন্দ্রখানা উচ্চবিদ্যালয় থেকে তানিয়া জিপিএ ৩ দশমিক ৪৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। এরপর ফুলবাড়ী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। লেখাপড়ার প্রতি অদম্য ইচ্ছাশক্তি তানিয়াকে এত দূর নিয়ে এসেছে। তানিয়ার ছোট ভাই তুষার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সে-ও কিছুটা শারীরিক প্রতিবন্ধী।

তানিয়া বলেন, ‘ইচ্ছা থাকলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কোনো বাধা নয়। আমি সর্বোচ্চ লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরি করতে চাই। আমাদের মতো গরিব ও প্রতিবন্ধীরা কত দূর যেতে পারব জানি না। এইচএসসি পরীক্ষার আগে বিনা পয়সায় পড়িয়েছেন কলেজের শিক্ষক রুহুল ইসলাম।’

তানিয়ার মা মরজিনা বেগম জানান, হাত না থাকলেও তাঁর মেয়ে প্রায় সব কাজ একা করতে পারেন। বাবা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘ওর ইচ্ছায় খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করাচ্ছি। ও লেখাপড়া শেষ করবে, চাকরি করবে। হামরা গরিব মানুষ।’

ফুলবাড়ী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মো. গোলাম ওয়াদুদ বলেন, তানিয়া লেখাপড়ায় ভালো। তাঁকে উপবৃত্তি দেওয়া আছে।

পরীক্ষাকেন্দ্রের সচিব ও ফুলবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম বলেন, তানিয়া খাতুন প্রতিটি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্ধারিত বাড়তি ২০ মিনিট ব্যবহার না করেই সব প্রশ্নের উত্তর লিখতে সক্ষম।