প্রকাশ্যে চলছে মাছ নিধন

চলছে জাটকা সংরক্ষণ অভিযান। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে নদীতে প্রকাশ্যে অবৈধ জাল পেতে মাছ ও পোনা ধরা হচ্ছে। গত ৩১ মার্চ ভোলার তজুমদ্দিনে মেঘনা থেকে।  ছবি: প্রথম আলো
চলছে জাটকা সংরক্ষণ অভিযান। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে নদীতে প্রকাশ্যে অবৈধ জাল পেতে মাছ ও পোনা ধরা হচ্ছে। গত ৩১ মার্চ ভোলার তজুমদ্দিনে মেঘনা থেকে। ছবি: প্রথম আলো

নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে প্রকাশ্যে ভোলার নদী থেকে মাছ শিকার করা হচ্ছে। মাছের মধ্যে আছে ইলিশ, পোয়া, তাপসী, পাঙাশসহ বিভিন্ন মাছের রেণুপোনা। বৈশাখ ঘনিয়ে আসায় জেলেরা আরও বেশি করে নদী মাছ ধরতে যাচ্ছেন।

মৎস্য বিভাগ বলছে, এখন জাটকা সংরক্ষণ অভিযান চলছে । গত ১ মার্চ (শুক্রবার) থেকে দুই মাস (মার্চ-এপ্রিল) ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর জলসীমানায় জাল ফেলা, মাছ শিকার, বহন, মজুত, কেনাবেচার ওপর নিষেধাজ্ঞা আনা হয়েছে। তারপরেও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মাছ শিকার হচ্ছে। এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে মৎস্য আইন অনুযায়ী দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, দুই হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

এক মাস ধরে ভোলার সদর উপজেলার রাজাপুর, ইলিশা কাঠিরমাথা, কাচিয়া, তুলাতুলি, ভোলাখাল, ভেদুরিয়া-ভেলুমিয়া, শান্তিরহাট, দৌলতখান উপজেলার মাঝিরহাট, চৌকিঘাটা, রাধাবল্লভ, সৈয়দপুর, হাজিপুর, বোরহানউদ্দিনের হাকিমউদ্দিন, মির্জাকালু, গঙ্গাপুর, তজুমদ্দিনের চরজহিরুদ্দিন, স্লুইসগেট, বাগানের খাল, চর মনতাজ, ভাসানচর, মনপুরার কলাতলি থেকে শুরু সর্ব-দক্ষিণে সামরাজ, ঢালচর-কুকরি-মুকরি, মুজিবনগর এলাকায় দেখা যায়, জেলেরা দিন-রাত জাল-নৌকা নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে নামছেন। এ সময় অবৈধ জাল বেশি পাতছেন।

দেখা যায়, মাঝনদীতে নৌকা কম। কৃষকেরা নদীর কিনারায়, ডুবোচরে, নদীর শাখা খালে কারেন্ট, বেহুন্দি, মশারি, চরঘোরা, ঘুন্ডি, পাই, পিটানো জাল, খুঁটিজাল পাতছেন। এসব জালে ছোট-বড় ইলিশ, ১-২ সেন্টিমিটার জাটকা ও শত প্রজাতির মাছের রেণু-পোনাসহ জলজ প্রাণী ধরা পড়ছে। মাছঘাটের আড়ত ও বরফ কলও চালু। মাছঘাট, আড়তদার, এমনকি ভোলার সদর রোডে প্রকাশ্যে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ বিক্রি হচ্ছে গভীর রাত পর্যন্ত।

ভোলায় নিবন্ধিত ১ লাখ ৩২ হাজার জেলে আছেন। অনিবন্ধিত আছেন আরও কয়েক হাজার। ভোলার ৭৫ জন জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছরে ১২ মাস। এর মধ্যে ৮ মাস ২২ দিন চলে সরকারি অভিযান। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জেলেদের জাল, নৌকা, মাছ জব্দ করছে। জেলেদের জেল ও জরিমানা করছে। ফলে জেলেরা বারবার জাল, নৌকা কিনে, জেল-জরিমানায় অর্থ ব্যয় করে ঋণী হয়ে থাকছে। এসব ঋণ তাঁরা নিচ্ছেন মাছঘাটের মহাজন, স্থানীয় সুদের কারবারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে। তাঁরা মাছ ধরছেন, আয় করছেন আর সেই টাকায় ঋণ শোধ করছেন। জেলের পকেটে কিছু থাকছে না, ঋণ ছাড়া।

জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্র জানায়, সাত উপজেলায় মার্চ মাসে ১১৮টি অভিযান হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসেছে ৭৩টি, মামলা হয়েছে ১০৭টি। এসব মামলায় ১৫৮ জন জেলের জেল এবং কিছু জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীর ৪ লাখ ৬৭ হাজার টাকা জরিমানা হয়েছে। এসব অভিযানে ২ দশমিক ১৬৩ মেট্রিক টন ইলিশ ও ৮ দশমিক ৭৫ মেট্রিক টন অন্যান্য মাছ জব্দ হয়েছে। এ সময় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মিটার জাল জব্দ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জেলেরা নদীতে মাছ ও আড়তে দাম বেশি পাওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতে যাচ্ছেন।

কয়েকজন জেলে বলেন, জেলের অভাব দূর করতে না পারলে নিষিদ্ধ সময়ে নদীতে যাওয়া বন্ধ করা যাবে না। জেলের অভাব দুই রকম। পরিবারের জন্য খাবার সংগ্রহ ও সপ্তাহ অন্তর বেসরকারি সংস্থার(এনজিও) কিস্তি পরিশোধ করা। অন্যদিকে মহাজনের চাপ তো আছেই। ঢাকাসহ সারা দেশের মোকাম ভোলার আড়তদারকে বৈশাখ এলে চাপ দেয় ইলিশের জন্য। আর আড়তদার চাপ দেয় জেলেকে।

সদর উপজেলার তুলাতুলি মাছঘাটের রফিক মাঝি বলেন, ‘জাইল্যা অভিযান মানবো ক্যামনে। এমন কোনো জাইল্যা নাই, য্যার সমিতির কিস্তি নাই, আঁর নিজের চাইরডা সমিতির সাপ্তাহিক কিস্তি দিতো অয়। সাপ্তার আগামাতায় চাইর হাজার টিয়ার খেল, নদীত যাই বা না যাই, ঘর-ভিডা বেচি অইলেও কিস্তি শোধাইতো অইবো।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম বলেন, মেঘনা ও তেঁতুলিয়া দুটি বিশাল নদী। লোকবলসংকটে পুরোটা দেখা সম্ভব নয়। জেলেরা আইন মানছেন না। কেন মানছেন না, সেটা ভাবতে হবে। পেটে ক্ষুধা থাকলে জেলেদের আটকে রাখা সম্ভব না। জেলেদের ঘরে আটকে রাখতে হলে পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা দিতে হবে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক বলেন, জাটকা সংরক্ষণ অভিযান ও উপজেলা নির্বাচন প্রায় একই সময়ে হওয়ায় অভিযানে ধীর আসতে পারে। বাকি সময়ে কঠোর অভিযান হবে। জেলেদের আরও সহায়তা দেওয়ার জন্য তিনি আবেদন জানিয়েছেন।