উদ্যোক্তা তৈরি করছে যে বাজার

দুধ মেপে ড্রামে রাখা হচ্ছে। ৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের গোগনগর এলাকায়।  প্রথম আলো
দুধ মেপে ড্রামে রাখা হচ্ছে। ৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের গোগনগর এলাকায়। প্রথম আলো

তিন সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু ছিল না নূর হোসেনের। পড়াশোনা করেননি। কৃষি ছাড়া অন্য কোনো কাজও জানা ছিল না। অর্ধাহারে-অনাহারে কাটানো ১৬ বছর আগের সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে আজও চোখ ভিজে যায় তাঁর।

সময়ের বিবর্তনে নূর হোসেনের পরিচয় বদলেছে। একসময়ের ভিটেবাড়িহীন নূর হোসেন এখন সফল খামারি। সবাই শুধু জানেন, দুগ্ধ খামার করে নূর হোসেন এখন কোটিপতি। তবে জানেন না তাঁর দিনবদলের পেছনের গল্পটা। যে গল্পের শুরু একটি দুধবাজার থেকে। ঋণে জর্জরিত নূর হোসেনের বাবা তাঁদের ভিটেবাড়ি বিক্রি করে দিলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পথে নামেন নূর হোসেন। প্রতিবেশীর একটি পরিত্যক্ত ঘরে সন্তানদের নিয়ে কোনোমতে দিন কাটান আর কাজ খোঁজেন। কাজ খুঁজে হয়রান নূর হোসেন একদিন সিদ্ধান্ত নেন, বাড়ির পাশের বাজারে দুধ বিক্রি করবেন। জমানো কিছু টাকায় গাভি কেনেন তিনি। পরের গল্পটা শুধুই এগিয়ে যাওয়ার। সেই বাজারে দুধ বিক্রি করেই নূর হোসেন একে একে ১০০ গরুর মালিক বনে যান। কোটি টাকার জমি কিনেছেন, ঘর হয়েছে, সন্তানেরাও হয়েছেন উচ্চশিক্ষিত। আর সচ্ছলতার নিচে চাপা পড়েছে অজস্র দিন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কাটানোর গল্পগুলো। নূর হোসেন জানান, হাতের নাগালে এমন একটি বাজার ছিল বলেই খামারি হয়ে ওঠা তাঁর।

নূর হোসেনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার গোগনগর এলাকায়। বাড়ির কাছেই ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ সড়কের এক পাশে গড়ে উঠেছে গোগনগর মণ্ডলবাড়ি দুধবাজার। প্রায় ৪০ বছরের পুরোনো এই বাজারের আশপাশের অন্তত ১৫টি গ্রামে ছোট-বড় ছয় শতাধিক খামার গড়ে উঠেছে বলে জানান দুধ বিক্রেতারা। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার মতে, এক হাজারের বেশি খামারে অন্তত ১০ হাজার গরু রয়েছে সেসব এলাকায়। প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার লিটার দুধ উৎপাদিত হয় খামারগুলোতে। এর মধ্যে ১০ থেকে ১২ হাজার লিটার বাজারে বিক্রি হয়, বাকিটা খামার থেকে সরাসরি সংগ্রহ করেন ক্রেতারা। বছরের প্রতিদিনই সকাল-বিকেল দুবেলা জমে উঠে এই বাজার। ঢাকা-মুন্সিগঞ্জসহ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকারি আর খুচরা ক্রেতারা যান গরুর খাঁটি দুধের জন্য। তেমনি একজন রাজধানীর ধানমন্ডির স্বপন ঘোষ। সহজ যাতায়াতব্যবস্থা ও ভালো মানের দুধের জন্য এক দশক ধরে এই বাজার থেকে দুধ সংগ্রহ করেন তিনি।

সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নারায়ণচন্দ্র জানান, বাজারের আশপাশের গ্রামগুলোয় ১৩৯টি নিবন্ধিত এবং ২৪০টি অনিবন্ধিত বড় খামার আছে। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় এক হাজার খামারে গরু আছে অন্তত ১০ হাজার। এই বাজার শুরু হওয়ার পর এটাকে কেন্দ্র করে খামারগুলো গড়ে উঠেছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বাসনা আখতার বলেন, ‘শুধু এই বাজারকে কেন্দ্র করে কয়েক হাজার মানুষ স্বাবলম্বী হয়েছেন। দারিদ্র্যবিমোচন, আত্মকর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে বাজারটি। সমৃদ্ধ করে তুলছে আমাদের দুগ্ধজাত শিল্পকে। বাজারটি সমগ্র বাংলাদেশের ডেইরি শিল্পে একটি ভালো উদাহরণ।’

সম্প্রতি অন্তত চার দিন কথা হয় বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে। ফল বিক্রেতা আবুল কাশেম জানান, একসময়ের পাট এবং ফল ব্যবসায়ী গোগনগরের মানুষ এখন গরু পালন করেন। ১৯৭৭ সালের আগ পর্যন্ত পাশের একটি গ্রামে দুধ বেচাকেনা করতেন তাঁরা। কিন্তু খাজনা আদায় নিয়ে ইজারাদারের সঙ্গে ঝামেলা হওয়ায় ওই বছরই গ্রামবাসী সিদ্ধান্ত নেন, নিজেদের গ্রামেই বসাবেন হাট। মণ্ডলবাড়ির পাশে ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ সড়কে শুরু হয় দুধ কেনাবেচা। খাজনা নিয়ে বিবাদকে কেন্দ্র করে বাজার গড়ে উঠেছে, তাই এই বাজারে খাজনা নেওয়া নিষেধ। দোকান কর্মচারী জামিল হোসেন এই বাজার থেকে দুধ কিনে শহরে বিক্রি করেন বাড়তি আয়ের জন্য। পরিবারের সদস্যদের জন্য নিয়মিত এখান থেকেই দুধ কেনেন গৃহিণী নিপা মণি। নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত সোনাই ঘোষের মিষ্টি, মিষ্টিমুখ কিংবা আদর্শের মিষ্টি তৈরিতেও ব্যবহৃত হয় এই বাজারের দুধ।

এলাকার মানুষের গরু পালনে উদ্বুদ্ধ হওয়ার পেছনে বাজারটির ব্যাপক প্রভাব আছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী আওলাদ মণ্ডল। তিনি বলেন, অল্প জায়গায় পরিবারের সবাই মিলে কাজ করা যায় এবং হাতের নাগালে দুধ বিক্রি করা যায় বলে মানুষ দুগ্ধ খামারের দিকে ঝুঁকেছে। মূলত শাহিওয়াল, ফ্রিজিয়ান ও অস্ট্রেলিয়ান সংকর জাতের গাভি পালন করেন এখানকার খামারিরা।

নূর হোসেনের ছেলে মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে ইংরেজিতে অনার্সপড়ুয়া আল আমিন বলেন, ‘ভবিষ্যতে খামার নিয়েই থাকতে চাই।’ বাজারে নিয়মিত দুধ বিক্রি করে তাজেক প্রধান উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী কাউসার। আট বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর সামান্য পুঁজি নিয়ে পারিবারিকভাবে গাভি পালন শুরু করে সে। প্রতিদিন গড়ে ২০ লিটার দুধ বিক্রি করে মা, বোন আর দাদাকে নিয়ে গড়া সংসার চলে তার। পড়াশোনা শেষে বড় খামারি হওয়ার স্বপ্ন কাউসারের।

এত সফলতার মধ্যেও খামারিদের আক্ষেপ, আশপাশে গড়ে ওঠা অসংখ্য ইটভাটা ও শিল্পবর্জ্যের কারণে গরুর খাবারের প্রাকৃতিক উৎসগুলো নষ্ট হচ্ছে। কৃষি ব্যাংকের অসহযোগিতা এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অবহেলার কারণে শিল্পটির প্রত্যাশিত বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাজারে আমদানি করা গুঁড়া দুধের কারণে খামারিদের আয়ের ধারাবাহিকতা ঠিক থাকছে না।